Friday, October 07, 2022

ভাগ্যিস !!





এরকম একটা ব্লগ  টাইটেল দেখে ঘাবড়াবেন না। টাইটেল টার যথাযথ একটা কারণ আছে। সৃজিত বাবুর ওয়েব সিরিজ "রবীন্দ্রনাথ কখনো এখানে খেতে আসেননি" যারা দেখেছেন তারা বুঝবেন । যারা দেখেননি তারা ভাগ্যবান। আমি গোগ্রাসে গিলেছি কারণ শুরুটা থ্রিলার মার্কা ছিল। তার উপর রাহুল  বোস অ্যাজ সিবিআই অফিসার চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছিল। নয়ন সুখ আর কি !! আমার এই বুড়ো বয়সেও। তবে কি জানেন সৌন্দর্য্যের অ্যাপ্রিসিয়েশন বয়স মানেনা। এখানে পৌরুষ শব্দটা বেশি প্রযোজ্য। অনির্বাণ অ্যাজ্ আতর আলি মাৎ করে দিয়েছে।

গল্পে আসি? এখন কথা হলো গল্পের গরু গাছে চড়ে  তবে আপনি লেখক হিসেবে গরুকে যদি মগ ডালে পা ঝুলিয়ে বসিয়ে দ্যান তাহলে গুল্প  আর গল্পে বেশি ফারাক থাকে না।

নিরুপম চন্দ মহাকাল পত্রিকার সাংবাদিক, সুন্দরপুর নামক পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার বর্ডারের কাছাকাছি স্থিত শহরতলীতে (?) একটি হোটেলের প্রচুর নামডাক শুনে খেতে আসেন। ক্রমশঃ প্রকাশ্যমান তিনি খাবারের চাইতে বেশী ইন্টারেস্টেড খাবার রাঁধুনি (মহিলা শেফ) ও হোটেলের মালকিন সম্বন্ধে যার চারপাশে জড়িয়ে আছে নানান গুজব ফ্রম রক্ত পিশাচিনী টু ডাকসাইটে ওয়েল কানেকটেড রহস্যময়ী নারী ।  মহিলাটি আবার দারুন রবীন্দ্র সংগীত অনুরাগী এবং যখন তখন, বিশেষ করে মাঝ রাত্রে, স্থান কাল পাত্র বিবেচনা না করে, "আয়েগা আনেওয়ালা" স্টাইলে সিচুয়েশন অনুযায়ী গান (রাবীন্দ্রিক ন্যাচারালি) গাইতে শুরু করেন। এমন কি মৃত দেহ গোর দিতে দিতে ও!! বুঝতেই পারছেন দা গরু ইজ ক্লাইম্বিং আপ দা ট্রী। 

এখানে বলা বাহুল্য এই হোটেলে কিছু মাসের মধ্যে কয়েক জন যুবক খেতে এসে নিরুদ্দেশ হয়েছে।  তাঁদের মধ্যে একজন  বাংলাদেশের মন্ত্রীর ভাগ্নে না ভাইপো ঠিক মনে নেই - মানে একজন কেউকেটা। স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের পশ্চিম বঙ্গ সরকার এই রহস্য উদ্ঘাটন করতে  উদগ্রীব।  কিন্তু যেই মহিলা আন্ডার দা স্ক্যানার তাঁকে সচরাচর পাবলিকে দেখা যায় না।  শুধু তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করতে গন্যমান্য ব্যক্তিরা গাড়ি করে আসা যাওয়া করেন।  বুঝতেই পারছেন ব্যাপার স্যাপার ''হাইলি সাস্পিশিয়াস''।

এর পর আরো চমকপ্রদ কিছু তথ্য সামনে আসে যেমন নিরুপম চন্দ ইজ নট এ সাংবাদিক বাট এ সিবিআই অফিসার যেটা  অ্যাকচুয়ালি প্রথম থেকেই যারা ভারতীয় (মানে হিন্দি, বাংলা ইত্যাদি) ছবির পোকা তাদের বুঝতে মোটেই অসুবিধা হবে না। আমি তো আবার সাব টাইটল পড়ে পড়ে ইংরেজি সিনেমাও দেখি। আমার তো কথাই নেই। 

গল্পটির লেখক (মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন) কি খেয়ে গল্পটি লিখছিলেন জানিনা। আমার ও পার বাংলার সৃজনীশীল মানুষদের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা আছে। সৃজিত বাবু ওয়েব সিরিজ করতে গিয়ে গল্পটিকে অবলম্বন করেছেন মাত্র। আমার বিশ্বাস এতে ওনার নিজস্ব মাল মশলা মানে ইন্টারপ্রিটেশন ও বহুত থাকতে পারে এতে  কোনো সন্দেহ নেই। তাই গল্পটা না পড়ে লেখকের প্রতি কোনো মন্তব্য করা সমিচীন নয়। অতএব স্পিক টি নট।

মানুষ যে সবচেয়ে স্বার্থপর ও মানসিক স্তরে অসুস্থ জীব এটাই বোধহয় এই গল্পের মূল ভিত। মনে আছে এই বাস্তব সত্যটির উপর লেখা শ্রী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের  একটি ছোট গল্প আমাদের পাঠ্য পুস্তকের অংশ ছিল। তবে সেই গল্পের কাঠামো অন্য, বক্তব্যের মিল থাকলেও মানসিক স্তরের অসুস্থ্যতাটা মূল্যায়নের বাইরে ছিল, ভাষার সৌন্দর্য ও শালীনতা  গল্পের সারকে আরো মর্মান্তিক করে তুলেছিল। 

সৃজিতের ওয়েব সিরিজের মূল্যায়ন আমার স্বল্প ক্ষমতার বাইরে। এই গল্পের (খল) নায়িকা পরিস্থিতির শিকার না জন্মগত ডাইনির ডি এন এ আক্রান্ত বলা মুশকিল। তবে তার স্ক্রীন প্রেসেন্সের  শট গুলি অত্যধিক ঝাপসা ও অতীব  লাল রঙের ব্যবহার রক্তাক্ত কারবারের ইন্ডিকেশান না সাসপেন্স ক্রিয়েশনের ফর্মুলা না অন্য কিছু আমার বোধগম্যর বাইরে। হয়তো আমার এই বিষয়ে কিছু লেখাই উচিত নয় কারণ সিনেমাটিক ল্যাঙ্গুয়েজের বা ভাষার উপর আমার কোনোই দখল নেই। আমি লিখছি একজন লে-পার্সন বা ভিউয়ার হিসেবে। আমার আফসোস একটাই এই ঝাপসা লালের মাঝে নায়িকার মানে মুস্কান ঝুবেরি চরিত্রের জামদানির কালেকশান ও কিছু-না-পড়লেও-চলত ব্লাউজ গুলো ভালো ভাবে দেখতে পেলাম না। আবার সেই ঝাপসালোকেই একটা সায়েন্স ল্যাবরেটরির মতন কিচেনে মহিলা রাবীন্দ্রিক অঙ্গে গান গেয়ে গেয়ে মাথার ঘিলু ফ্রাই করে চলেছেন - ওই মানে কোনো নতুন ডিশের এক্সপেরিমেন্ট করছেন  ..... না অন্য কিছু?

তবে পিশাচিনীর  সেন্স অফ এথিক্স আর ই আর মানে এমপ্লয়ী রিলেশন যেকোনো কর্পোরেট কে হার মানাতে পারে।  যারা ওঁর ওয়াফাদার তাঁদের  মন প্রাণ ধন দিয়ে বাঁচানোর প্রচেষ্টা খুবই টাচিং !

শেষের দিকের এপিসোড গুলোর শুরুতে দেওয়া ডিসক্লেমার  - নিজের হৃৎপিণ্ড সামলে পরের  দৃশ্যগুলো দেখবেন কারণ সে গুলো অসম্ভব রকম ভয়াবহ - আমার মত কঞ্জেনিটালি ভিতু লোককেও ভয়ার্ত করতে অসমর্থ হলো কারণ এগেন সৃজিত বাবুর আধো আলো আধো আঁধারিতে কিস্যুই বোঝা গেলো না শুধু সংলাপই গল্পের দড়ি টানলো এবং গোটা ব্যাপারটা বোঝা গেলেও একটু অতি মাত্রায় ওই সীন গুলোকে টেনে লম্বা করে ভয়ের চাইতে বোরিং বেশী করে ফেললেন নির্দেশক। আবার বলবো স্ক্রিনপ্লে অত্যন্ত প্রেডিকটেবল। এবং আলো আঁধারির এস্থেটিক্স বুঝতে গিয়ে চোখের মণির ব্যথা বাড়লো।

কিন্তু সিবিআই সাহেবের টেম্পোরারি স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়াটা কি নিতান্তই প্রয়োজন ছিল?  সেই মাল্টি স্টোরিড  বিল্ডিংয়ের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চিল চিৎকার ?  পিশাচিনীর সম্মুখীন হয়ে চেয়ারে বসে ব্রেক ডান্স ? সৃজিৎদা এ কি করলা  ? আমাগো হি ম্যানরে এত্ত আনডিগনিফাইড পস্চার গুলিতে না দেখালে কী চলত  না ? এখানে কিছু লিগ্যাল প্রশ্ন ও উঠে আসে। বাঘ কে সে কেন ছাগ শিশু শীকার করে খায় এই নিয়ে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় কি? তেমনি ভ্যাম্পায়ারের উপরে কি কেস করা যায়? এই দ্যাহেন কথায় কথায় একটা স্পয়লার দিয়া দিলুম। কিসু মনে করবেন না য্যান।

সৃজিত বাবুর সব সময় বড় বড় আর্টিস্ট নিয়ে কারবার। অঞ্জন দত্ত কে আমার ভালো লাগে - তাঁর কিছু কিছু গান, পারফরম্যান্স, স্ক্রীন প্রেসেন্স, গলার আওয়াজ। অনেক বছর আগে ওকে সামনাসামনি দেখেছি। মেক আপ করা মুখ। চোখের তলায় ব্যাগস। এখন বয়স হয়েছে ভদ্রলোকের। হয়তো সেই কারণেই ব্যাগ গুলো আরো প্রমিনেন্ট হয়ে প্রায় ঝুলে পড়েছে। মনে হচ্ছিল চশমার তলা থেকে বেরিয়ে আসবে। এ ব্যাপারে কি কিছুই করা যায় না ? উনি পাবলিক ফিগার। চেহারায় চাকচিক্য না হোক অ্যাট লিস্ট স্বাস্থ্য সম্বন্ধে একটু সতর্ক ও সচেতন হওয়া কি যায় না অঞ্জনদা?

সমীক্ষান্তে বলি এ পার হোক কি ও পার হোক পুলিশ যে কতখানি অপদার্থ তা সর্ব সমক্ষে আবার তুলে ধরার জন্য থ্যাংকু লেখক ও নির্দেশককে।  

আর সর্বান্তে  ভালো করেছেন কবিবর এই রসনাগারে চরণ ধুলি দেননি। যদি দিতেন তাহলে ওনার লেখা তিন হাজার গানগুলো কে লিখতো? আর অজস্র কবিতা, চিঠি , ছবি,  গল্পো, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নৃত্য নাট্য, গীতি নাট্য আরো কত কি? তাই ভাগ্যিস!!



Friday, September 16, 2022

মুষিক পুরাণ


আমাদের নিচের তলার ফ্ল্যাট। তাই প্রায়ই বাড়িতে ছোট  বড় নানান সাইজের ইঁদুর ঢুকে পড়ে। খেলাধুলা করে। নাচানাচি করে। আমার পোষ্যটি দার্শনিকের মতন তাকিয়ে তাদের নাচাকোদা, ছোটাছুটি দেখে ফোত করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ল্যাও ঠ্যালা। 

ফ্ল্যাটের সামনেই পার্ক। সেই পার্কে আবার বিশাল বড় বড় সাইজের ইঁদুর, যাদেরকে ইংরেজিতে রোডেন্ট বলে, লাফিয়ে বেড়ায়। ব্যালকনিতে রাত্রে তাদের ডাকাডাকি, হুড়োহুড়ি শোনা যায়। চিকার দল ও আছে। তাদের কথোপকথন কানে আসে। এদের মধ্যে কোনটি যে গাড়ির মধ্যে ঢুকে তার কাটে, পাইপ কাটে বলা মুশকিল। তবে এ ঝঞ্ঝাট ও  আমাকে একাধিকবার পোয়াতে হয়েছে। 

মুষিকের আগমনে ইঁদুর কল, আঠা দেওয়া বই যাতে ইঁদুর চিপকে যেতে পারে ইত্যাদির ব্যবস্থা বাড়ির ভিতর রাখা অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

কিন্তু এত সব ব্যবস্থা সত্বেও এবার যাঁর  চরণ ধুলি আমাদের বাটিতে পড়েছে সে যে মহা ধুরন্ধর তা বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে। ইঁদুর কলে ঘী দেওয়া রুটি থেকে মাংসের টুকরো দিব্যি সে আত্মসাৎ করে আমাদের কলা দেখিয়ে আশেপাশে ল্যাজ উঠিয়ে নির্লজ্জের মতন খেলে বেড়াচ্ছে। দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে। অথচ কিচ্ছুটি করার উপায় নেই কারণ আমার "সক্রেটিস" পোষ্য নির্বিকার চিত্তে তাঁকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। একবারও থাবা উঠিয়ে শাসানো তো দূরের কথা ভৌ ভৌ পর্যন্ত করছে না।

শেষ পর্যন্ত আঠা লাগানো বইটিই কাজে এলো। ঘুরন্ত জামাই ( মহিলা কিনা জানিনা তবে জামাই আদরে বাঁদর হয়ে যাচ্ছে তাই জন্যে আর কি...) শেষে আঠা যুক্ত বইয়ে ধরা পড়লো। তাঁর শেষ সৎকার মানে তাঁকে বই থেকে ঝেড়ে পার্কে ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম। তবে আঠা মুক্ত হয়ে তাঁর শারীরিক অবস্থা খুব একটা সুখকর ছিল না। প্রায় নির্জীবই বলা চলে। দুর্ভাগ্য বসত: এক জোড়া কুকুর তাঁর পিছন নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ইন্দুরটির কী দশা হয়েছিল বলতে পারবো না।

তবে তাঁর দুর্বল শরীর দেখে কষ্ট হচ্ছিল। যাইহোক জীব তো ! আর জীব হত্যা মহাপাপ। মানুষের জীবনের এটাই সবচেয়ে বড় contradiction।  যা সে পায় না বা যতক্ষণ পায় না ততক্ষণ সে ছটফট করে নানা বিধ উপায়  খোঁজে তাকে পাওয়ার  - তা সে কোনো প্রাপ্তি হোক বা বিপদ থেকে মুক্তি হোক। কিন্তু সফলকাম হয়েও সন্তুষ্টি থেকে সে ক্রোশ দূরে থাকে হয় আরো পাওয়ার লোভে বা পেয়েও অশান্ত চিত্ত হয়ে আর বিবেকের তাড়নায়  ছটফটিয়ে।

আশা করি একটি মুষিকের শেষ কৃত্যের ভাগী হয়ে আমি যেই দর্শন লাভ করেছি তদ্দারা আপনারা যথাযথ অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ  বোধ করবেন।

আচ্ছা রাখি তাহলে ..  

Tuesday, September 06, 2022

মণি মাসির সোলো ট্র্যাভেল

 











বেশ ফুরফুরে হাওয়া। 

আকাশটা গাঢ় নীল।

ছোটো ছোটো ধপধপে সাদা মেঘ ভেসে চলেছে যেন স্বচ্ছ জলের ধারার উপর বহমান সাদা পাল তোলা নৌকোর সারি।

একটা ঝিরঝিরে পাহাড়ী ঝর্ণা পাথুরে রাস্তা বেয়ে নেমে গেছে নিচে কোথাও।

মণি মাসির জায়গাটা ভালো লেগেছে।

কাছেই একটা গ্রাম আছে। কিন্তু এই পাহাড়ের কোলে বসতি কম। শহর থেকে খুব কাছেও নয় আবার খুব যে দুর তাও বলা চলে না। কে বলেছিল এই অচিনপুরের কথা। পাড়ার দত্ত জেঠু।

একা ঘুরতে যাওয়ার জন্য আইডিয়াল। মণি মাসির অনেক দিনের শখ সোলো ট্র্যাভেলের। দাদা কম কথার মানুষ। শুধু বলেছিলেন দেখেশুনে যেও। বৌদি বিশেষ  কিছুই বলেননি। দাদার শ্বাশুড়ি দাদা বৌদির সঙ্গেই থাকেন। তিনি শুধু আড়ালে বৌদিকে বলেছিলেন "যত্ত সব। সোলো আবার কী রে?" বৌদি কোনো উত্তর দেননি।

মণি মাসির রিটায়ারমেন্ট হয়েছে গত মাসে। চল্লিশ বছর স্কুলের শিক্ষিকা হিসেবে ওনার যথেষ্ঠ নাম ছিল....না এখনও আছে। অঙ্কের এমন ভাল টিচার হয় না এটা সবাই এক কথায় মানত .... এখনো মানে। এগারো বারো ক্লাসের পড়ুয়াদের মারা নিশ্চিন্ত ছিল যে রিটায়ার করে মণি মাসি প্রাইভেট টিউসান নেবেন আর তাদের অকালকুষ্মান্ড বাচ্চাগুলোর একটা হিল্লে হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের মাথায় পড়লো বাজ।

আসলে মণি মাসিকে কেউ অঙ্কের টিচার ছাড়া আর কিছু কোনোদিন ভাবেনি। কিন্তু মণি মাসির একটা স্বপ্নের জগৎ আছে যেটাকে তিনি অঙ্ক কষতে কষতে ও জিইয়ে রেখেছিলেন। আর সেটা হলো অজানা অচেনা জায়গা ভ্রমণ তাও আবার একক।

চল্লিশ বছর ধরে ইস্কুলে ছাত্র - ছাত্রীদের চিল্লামেল্লি, দাদা বৌদির কনস্ট্যান্ট আনুগত্য, দাদার শ্বাশুড়ির অনুচিত এবং অকারণ ঠোনা - এই চিরাচরিত জীবনের একঘেয়ে রুটিন থেকে বেরিয়ে, কোনো অচেনা অজানা জায়গায়, যেখানে তাঁকে কেউ চেনে না বা জানে না, সেখানে কিছুদিন বিশ্রাম - একেবারে স্বর্গীয় অনুভুতি!

মণি মাসিকে কেউ কখনো দিদি বা দিদিমণি বলে ডাকেনি। কেন? বলা মুশকিল। ইস্কুলের ছাত্র - ছাত্রী, সহকর্মী, পাড়ার আবালবৃদ্ধবনিতা মায় নবজাগরণ বিদ্যালয়ের প্রিন্সিপাল, (যেখানে মণি মাসি নিজের জীবনের অর্ধেকটা কাটিয়েছেন), শম্ভুনাথ ভটচার্জি বাবুও মণি মাসিকে মণি মাসি বলেই চিরকাল ডেকে এসেছেন। হয়তো মণি মাসির মোটাসোটা ভারিক্বী পার্সোনালিটির জন্য.... হয়তো বা মণি মাসির মধ্যে একটা ইউনিভার্সাল মাসি - মাসি ভাব আছে.... হয়তো.... সে যাকগে। এখন মোদ্দা কথা হলো মণি মাসি তার রিটায়ার্ড লাইফ  ভরপুর এনজয় করছেন ।

ঝর্নার ধারে ছোটো বড় অনেক রকমের পাথর। তাদের নানান সাইজ। পাথরের ওপরটা বেশ মসৃণ। মণি মাসি একটা বড় পাথর বেছে নিয়ে পা ঝুলিয়ে বসলেন ঠিক যাতে জলের ধারা তাঁর পায়ের আঙ্গুল গুলো ছুঁয়ে যায়। জলটা বেশ ঠাণ্ডা কিন্তু সুদিংও। মণি মাসির আরাম বোধ হচ্ছে। মনটা একটা অদ্ভুত আনন্দে ভরে উঠছে। আনন্দ নয় ... একটা স্বাধীন, সম্পূর্ন সত্তার  অনুভুতি....নিজেকে একটা উড়ন্ত পাখির মতন লাগছে। মণি মাসি এই শাঠ পার হওয়া জীবনে কখনো এরকম একটা প্রাণ খোলা, বন্ধন বিহীন একসিস্টেন্স অনুভব করেননি।

মণি মাসির প্রাণের  উচ্ছ্বাস আর ঝর্ণা ধারার জলতরঙ্গ মিলে মিশে একাকার হয়ে গেলো। মাসি গুনগুনিয়ে উঠলেন.... সেই কোন যুগে স্কুলের কোরাসে গাওয়া ...

তোমারই ঝর্ণা তলার নির্জনে
মাটির এই পরশ আমার
ছাপিয়ে গেলো কোন খানে... এ... এ.... এ

"বাঃ!"

মণি মাসি চমকে উঠে পিছনে তাকিয়ে দেখলেন। এই নির্জন ঝর্নার ধারে যে অন্য কেউও আছে সেটা তো জানা ছিল না।

ভদ্রলোক বেশ সুপুরুষ। দুধে আলতারং। পেটানো শরীর। লম্বায় ছ ফুট তো বটেই। এক মাথা সাদা ধপধপে চুল। চোখে চশমা। নীল টি শার্ট। ছাই রঙা প্যান্ট। পায়ে সাদা স্নিকার। গলায় একটা ক্যামেরা ...না বাইনোকুলার ঝুলছে। চেহারায় আভিজাত্য সন্দেহাতীত ভাবে ছলকে পড়ছে। বয়স শাঠ কিংবা সত্তর হবে।

"আপনার গলাটা তো বেশ।"

মণি মাসি লজ্জায় আড়ষ্ট। মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। কেউ যদি বলতো মণি মাসি অঙ্কে মাস্টার বা পারদর্শী তাহলে হয়ত তিনি তাচ্ছিল্যের হাঁসি হাঁসতেন। কিন্তু গান? মণি মাসিকে বোধহয় কেউ বাথরুমেও গুনগুন করতে শোনেনি।

"এখানে কি বেড়াতে? "

মণি মাসি সামান্য মাথা নাড়লেন।

"এখানে সচরাচর কেউ একটা বড় আসে না। বড় নির্জন। আজকাল লোকেরা হট্টগোল বেশি পছন্দ করে। যাক, আপনি এসে পড়েছেন ভালো লাগলো। কতদিন?"

মণি মাসি কোনো রকমে আড়ষ্টতা কাটিয়ে খুবই আস্তে বললেন, "এই পাঁচ দিন।"

"ভালো। কোথায় উঠেছেন? ডাক বাংলোয়? ওছাড়া তো আর এখানে কোনো থাকার জায়গা নেই।"

মণি মাসি আবার আস্তে করে মাথা নাড়াতে ভদ্রলোক "তাহলে আবার দেখা হবে" বলে ঝর্নার ধার ধরে সোজা হেঁটে চলে গেলেন।

মণি মাসি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে বাংলোর দিকে ফিরে এলেন। তিনি  কাল যখন চেক ইন করেছিলেন তখন বাংলোর ম্যানেজার হাথ কচলে কিন্তু   কিন্তু করে জিজ্ঞেস করেছিলেন মণি মাসির একা থাকতে অসুবিধে হবে কিনা কারণ বাংলোতে তখন আর কেউ ছিল না। মণি মাসি ভিতু হলে কি আর সোলো ট্র্যাভেল করেন। তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে জানিয়েছিলেন যে তাঁর কোনো অসুবিধে হবে না। এ ভদ্রলোক বোধহয় আজই এসেছেন যখন মণি মাসি এধারটা এক্সপ্লোর করতে বেরিয়েছিলেন।

বাংলোয় সকালে ম্যানেজার বাবু থাকেন। তিনিই আবার  রিসেপশনিস্ট। সকালে রান্নার লোক ও থাকে। ভালো রাঁধে। রাত্রির খাবার বানিয়ে চলে যায়। রাত্রে কেয়ারটেকার থাকে। আর আছে বাচ্চু। সে বাংলোতেই চব্বিশ ঘন্টা থাকে। কোথাও যায়না।

রাত্রে পাতলা মাছের ঝোল দিয়ে পেট ভরে ভাত খেয়ে মণি মাসি ঠিক দশটা নাগাদ বিছানায় গা এলালেন। মাঝ রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেংগে গেল। দরজার নিচে আলোর ঝলক দেখে মণি মাসির মনে হলো হয়তো কেউ বাংলোয় চেক ইন করেছে। শহর থেকে অচিনপুর
আসা যাওয়া শুধু বাসেই হয়। খুব কম লোক এখানে আসে। তাদের মধ্যে ট্যাক্সি বা নিজের গাড়ি করে আসার লোক বিরল। রাতের বাস প্রায়: সই লেট করে। তাই যেই এসে থাকুক তার পৌঁছতে দেরি হয়েছে।

করিডোরে আসা যাওয়ার নানা রকম শব্দ। খস খস ঘস ঘস - মাল টানার..... তারপর পায়ের শব্দ। একটা ঘরের দরজা খোলা তারপর বন্ধ হওয়ার আওয়াজ। কিছুক্ষণ পর সব শব্দই আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেলো। মণি মাসি বুঝলেন যিনি বা যারা এসেছে তারা এখন ঘরেতে সেটল করে গেছে। তবুও করিডোরের আলো জ্বলছে। মণি মাসির আবার ঘুমোবার সময় একটুও আলো সহ্য হয় না ....মানে আলো জ্বললে ঘুম আসে না। ভাবলেন একবার ইন্টারকমে বাচ্চুকে ডেকে বলবেন করিডোরের আলোটা নেভাতে। হাত বাড়াতেই যাচ্ছিলেন কিন্তু সেই মুহূর্তেই করিডোরে পুরুষ কণ্ঠে কে যেন গেয়ে উঠলো ....

তোমারই ঝর্ণা তলার নির্জনে
মাটির এই পরশ আমার

মাঝ রাতে...? দরাজ গলায় কে গান গায়? মণি মাসি কৌতূহল চাপতে না পেরে উঠে দরজা খুলে উঁকি মারলেন। করিডোরে কেউ নেই....তার পর মুহূর্তেই অন্ধকার। কে যেন টুপ করে আলোটা নিবিয়ে দিলে।

মণি মাসি দরজা বন্ধ করে খাটে এসে শুয়ে পড়লেন। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আর আসে না। এপাশ ওপাশ করে, মাথার উপর গায়ে চাপা দেওয়ার  চাদরটা  টেনে, অনেক ক্ষণ নানান রকমের চিন্তা করতে করতে কখন জানি চোখ দুটো বুজে এলো। ঠিক ঘুমটা আসবে আসবে করছে সেই মুহূর্তে মণি মাসির হঠাৎ খেয়াল হলো উনি ভুল শোনেননি। করিডোরে কেউ তো ছিল। উনি সিগারেটের গন্ধ পেয়েছিলেন।

তৃতীয় দিন সকালে মণি মাসি ঘুম থেকে উঠে স্নান ইত্যাদি সেরে খাবার ঘরে পৌঁছে বাচ্চুকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন কাল রাতে কে বা কারা বাংলোতে এসেছে। বাচ্চু বললো, " কই না তো কেউ তো আসেনি  মাসি।" মণি মাসি জোর দিয়ে বললেন, " তবে যে করিডোরে আলো জ্বলছিল মাঝ রাতে?" বাচ্চু বললো, "ও সে তো মাঝে মাঝেই জ্বালিয়ে দেখতে হয়। কাল রাতে আওয়াজ পেলাম মনে হলো। জংলী জানোয়ার মাঝে মধ্যেই বাংলোতে এসে পড়ে।  আলো জ্বালালে আবার পালিয়ে যায়।" এরপর মণি মাসি আর গানের কথা তুললেন না । ব্রেকফাস্ট সেরে হাঁটা দিলেন ঝর্নার ধারে ।

এই জায়গাটা সত্যিই সুন্দর। সবুজ মাঠ পেরিয়ে এক ফালি রাস্তা বেয়ে একটু নেমে গেলেই ঝর্নার ধার। আর যদি নিচে না নাম তো মাঠ পেরিয়ে উল্টো দিকে সোজা গেলে বড় রাস্তা। রাস্তা পেরিয়ে পনেরো মিনিট মতন হাঁটলে দোকানের সারি। রোজকার জিনিস। সবজি পাতি। মাছ মাংসর বাজার। শোর গোল...ভিড় ও বটে। কাছে পিঠে গ্রাম বা ছোটখাটো বসতি থেকে লোকেরা আসে দোকান বসাতে আর খরীদারি করতে ও। মণি মাসি ওদিকটা একবার গেছিলেন। ভালো লাগেনি বাজার হাটের চিল্লামেল্লি। এই সব থেকে বাঁচার জন্যেই তো এখানে আসা। ঝর্নার ধারে বসে জলের কলকলানি শোনা। পাখিদের গান আর মিষ্টি ফুলের সুবাস মাখো গায়ে। ফুরফুরে হাওয়া বয়ে আনে নাম না জানা ফুলের  গন্ধ। মণি মাসি পাখিদের নাম জানেন না, ফুলের গন্ধ চিনতে পারেন না। এখানে সবই অচেনা। তিনি ও এখানকার বাসিন্দাদের কাছে একজন অচেনা মানুষ। এই তো তিনি চান। অচেনা হয়ে থাকতে। এই জায়গাটার নামটাও এক্কেবারে মানানসই - অচিনপুর।

আজকে কিন্তু তিনি একা নন। একটা পাথরের উপর বসে ডান দিকে মাথা ঘোরাতেই দেখলেন কালকের সেই ভদ্রলোকটিকে। কিছু দূরে আরেকটা বড় পাথরের উপর বসে নির্নিমেষ চোখে ঝর্নার ওপারে একটা ঝাঁকড়া গাছের দিকে চেয়ে আছেন। যেন ধ্যানস্থ। নি:শ্বাস ও পড়ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। গলায় সেই বাইনোকুলার। পরনে সেই নীল টি শার্ট, ছাই রঙ্গা প্যান্ট আর পায়ে সাদা স্নিকার। মণি মাসির মনে হলো ভদ্রলোকটিকে ডিস্টার্ব করা অনুচিত হবে। মিনিট খানেক ঝর্নার জলে পা ডুবিয়ে বসে থেকে মণি মাসি উঠে এলেন। আজ না হয়  বাংলোর পিছন দিকটা ঘুরে দেখবেন।

মাঠ পেরিয়ে বাংলো। ছিমছাম, পরিষ্কার একতলা বাড়ি। একটা ছোটো বাগান দিয়ে ঘেরা। বাংলোর চার পাশের দেয়ালটা বেশ নিচু। বাচ্চু ঠিক বলেছিল। জংলী জানোয়াররা পাঁচিল টপকে ভিতরে আসতেই পারে। বাংলোর পিছন দিকটায় বিশেষ কিছুই নেই। খালি রাস্তা বাস ডিপোর দিকে চলে গেছে।

লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। মণি মাসি বাংলোয় ফিরে এলেন। ম্যানেজার বাবু "আজ কোথায় কোথায় ঘোরা হলো" বলে আলাপ জমাতে এলেন। মণি মাসি জানালেন ওনার বাজার হাট, বড় রাস্তা, মাঠ সব ঘোরা হয়ে গেছে। তবে ঝর্নার ধারটা সব চেয়ে ভালো লেগেছে বলাতে, ম্যানেজার বাবুর হাঁসিখুশী মুখটা যেন একটু গম্ভীর হয়ে গেলো। "ও দিকটা একটু সাবধানে যাবেন। ঝর্নার ধারের পাথর গুলো বড় পিছল আর অনেক সময় অনেক জংলী জানোয়াররা ওখানে জল খেতে আসে। আপনার বয়স হয়েছে....।" মণি মাসি  এই বয়সের ইঙ্গিতটা ঠিক বুঝলেন না। জংলী জানোয়াররা কি অল্প বয়স্কদের অ্যাটাক করবে না। উনি আর কথা বাড়ালেন না। আচ্ছা বলে লাঞ্চের অর্ডার দিতে ভিতরে চলে গেলেন।

বিকেলে আবার সেই ঝর্নার ধার মণি মাসিকে যেন বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকে। তবে এবার সেখানে পৌঁছে মণি মাসি রীতিমত অবাক হলেন। ঝর্নার ওধারে যেই ঝাঁকড়া গাছটাকে নীল টি শার্ট পরা ভদ্রলোক নিস্পলক চোখে ঝর্নার এপারে বসে দেখছিলেন সেই গাছেরি ছায়ায় বসে উনি অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে একটি বই পড়ছেন। গলায় বাইনোকুলার তো আছেই। মণি মাসি বুঝে উঠতে পারলেন না ভদ্রলোক ওপারে গেলেন কি ভাবে? ঝর্নাটার গভীরতা কম। কিন্তু তোর অনেক বেশি। জল স্বচ্ছ । তাই জলের নিচে ছোট বড় অনেক পাথর পরিষ্কার দেখা যায়। ভদ্রলোক যদি ঝর্নার উপর দিয়ে হেঁটেও পার হয়ে থাকেন তবে ও স্লিপ করার চান্স অনেক বেশী কারণ কোনো গাছের ডাল বা এমন কোনো জিনিস নেই যার উপর ভর করে ঝর্ণা পার হওয়া যায়। আর একবার স্লিপ করলে জলের প্রবাহে বয়ে যেতে দেরি লাগবে না। মণি মাসির মনে পড়ে গেলো প্রথম আলাপের পর্বে ভদ্রলোক হন হন করে ঝর্নার ধার দিয়ে উল্টো দিকে রওনা হয়েছিলেন। মণি মাসি ঠিক করলেন কাল ভোরে বেরিয়ে ঝর্নার ধার ধরে হেঁটে এগিয়ে গিয়ে দেখবেন ওপারে যাওয়ার কোনো রাস্তা আছে কি না। এখন সূর্য প্রায় ঢল ঢল। মণি মাসি বাংলোর দিকে রওনা হলেন।

কিন্তু পরের দিন মণি মাসির আর ঝর্নার পারে যাওয়া হলো না। ঘুম থেকে উঠেই কিরকম গা ম্যাজম্যাজ করে উঠলো। আর মাথায় অসম্ভব যন্ত্রনা। একটা প্যারাসিটামল খেয়ে মণি মাসি সটান বিছানা নিলেন। ঝর্নার ঠাণ্ডা জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকার দরুনই হোক বা সকাল বেলার ফুরফুরে হওয়ায় ঘুরে বেড়ানোর দরুনই হোক মণি মাসির চতুর্থ দিনের সোলো ট্র্যাভেল বাংলোয় নিজের ঘরে শুয়েই কাটাতে হলো। পরের দিন বাড়ি ফেরার কথা তাই আর কোনো রিস্ক না নিয়ে ঝর্নার ধার দিয়ে নতুন কোনো পথের সন্ধানে বেরোনোর অ্যাডভেঞ্চারটা ট্র্যাভেল আইটিনেরারি থেকে বাদ দিতে হলো।

পঞ্চম দিন সকাল দশটার মধ্যে রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে ব্যাগ গুছিয়ে এগারোটার বাসটা ধরবার জন্য মণি মাসি বাস ডিপোতে হাজির হলেন। বাস ডিপো মানে একটা টিকিট ঘর। তার দু পাশে দুটো অশ্বত্থ গাছ হেলে পড়ার দরুন টিকিট ঘরটার সামনে পাতা কয়েকটা পাথরের বেঞ্চগুলো ছায়াকীর্ণ। পঁচিশ মিনিট বসার পর বাস এল। ম্যানেজার বাবু বলে দিয়েছিলেন বাস পনেরো কুড়ি মিনিট থামে। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। মণি মাসি ব্যাগ হাতে করে বাসের দিকে রওয়ানা দিলেন। কোন বইতে পড়েছিলেন ওয়ান শুড ট্র্যাভেল লাইট তাই একখানা ব্যাগেই মণি মাসির যাবতীয় দরকারি জিনিস গুছিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। ব্যাগ বেশি ভারিও নয়। আর দু কদম.... হঠাৎ পিছন থেকে একটি পরিচিত ভারি কণ্ঠস্বর, "চললেন?" মণি মাসির চিনতে সময় লাগলো না কণ্ঠ স্বরটি কার? মনে হলো যেন তিনি সেই স্বরটি শোনার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। পিছন ফিরে আবার সেই আড়ষ্ট ভাবে ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালেন। মণি মাসি এগারো বারো ক্লাসের বেয়াড়া ছেলে মেয়েদের চিরকাল ভীতির পাত্রী ছিলেন। কিন্তু এই সহজ, আলাপি ভদ্রলোকের সামনে একজন শাঠত্তর মহিলার এমন সলজ্জ ব্যবহারের কারণ মণি মাসি নিজেও বোধহয় বিশ্লেষণ করে উঠতে পারলেন না। ভদ্রলোকের কাঁধেও একটা  ওভারনাইটার দেখে বুঝতে অসুবিধে হলো না যে উনি ও বাড়ি ফেরার তাগিদে। "যাক, কিছুদিন ভালো কাটলো তো?" উত্তরের অপেক্ষা না করেই ভদ্রলোক গুড লাক বলে এগিয়ে গেলেন দাঁড়ানো বাসটার পিছন দিকে। মণি মাসি খেয়াল করেননি ততক্ষণে আরেকটা বাস এই বাসটার পিছন দিকে এসে দাঁড়িয়েছে।

বাসে চড়ে জানালার পাশের একটা সিটে মণি মাসি গুছিয়ে বসলেন। ছ ঘণ্টার পথ। পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে। তাও যদি বাসটা ঠিক সময় ছাড়ে। এরই মধ্যে আরেকজন যাত্রী উঠে মণি মাসির পাশের সিটটি দখল করলো। লোকাল মনে হয়। পাজামার উপর চেক কাটা বুশ শার্ট  পড়া। মাথায় টাক। টাকের তিন পাশে কাঁচা পাকা ছোটো ছোটো চুল। তার মধ্যে শুধু দু তিন গাছি চুল লম্বা যেটা দিয়ে টাক টাকে ঢাকার লোকটা ব্যার্থ চেষ্টা করেছে। গায়ের রং পীত বর্ণ আর চোখ দুটো অসম্ভব রকমের বড় আর গোল গোল। মণি মাসির এই প্রথম কাউকে দেখে বিরক্তি এট ফার্স্ট সাইট জন্মালো। লোকটার একটু হে হে ভাব আর গায়ে পড়ে আলাপ জমানোর চেষ্টা। মণি মাসি সিট টা বদলাবেন কিনা ভাবলেন। তারপর মত পরিবর্তন করলেন। সিট বদলালেই যে ভাল কো - প্যাসেঞ্জার পাবেন তার কি মানে?

ভদ্রলোকের নাম গোরক্ষনাথ ঘোষাল। নিজেই জানালেন। মণি মাসির খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পুরো হরোস্কপ বাস চলার সঙ্গে সঙ্গে জেনে নিয়েছেন। মণি মাসির হঠাৎ খেয়াল হলো তিনি কিন্তু সেই অচেনা আলাপি ভদ্রলোকের সম্বন্ধে কিছুই জানেন না। তিনিও কিন্তু মণি মাসির আদ্যোপান্ত কিছুই জানার চেষ্টা করেননি। কতবার  তো দেখা হলো। তার ঠিক বিপরীত এই 
গোরক্ষ বাবু।

মণি মাসি ডাক বাংলোয় উঠেছিলেন তায় আবার একলা শুনে ওনার গোল গোল চোখ আরো গোল গোল হয়ে গেলো। তারপর কোন কোন জায়গা ঘুরেছেনের লিস্টে ঝর্নার ধারের কথা শুনে লোকটি যেন কেমন চুপসে গেলেন। বেশ কিছু ক্ষণ চুপ করে থেকে একটু আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন, "আপনার সঙ্গে ঝর্নার ওদিকটা কোনো ইয়ে মানে অঘটন - টঘটন ঘটেনি তো?" মণি মাসি বেশ জোর গলায় বললেন, " কই না তো।" লোকটি আবার আরেকটু বেশী আমতা আমতা করে বলল, "না মানে কয়েক বছর আগে এক গাছপালাবিদ প্রফেসর ওই ঝর্নার ধারটা তেই পিছল পাথরে পা পিছলে মারা যান কিনা।শোনা যায় প্রায়ই নাকি ওধারে তাকে দেখা যায়। তাই কেউ আর ওদিকটা সচরাচর যায় না। আপনার ঐ ডাকবাংলোতেই তো উনি উঠেছিলেন। আপনি ওদিকটা এতোবার গেছেন কাউকে.... " শেষের দিকটা মণি মাসি পরিষ্কার শুনতে পারলেন না। বাস চালক ভীষণ জোরে হর্ন বাজিয়ে হঠাৎ হ্যাঁচকা একটা ব্রেক কষে বাস টাকে ডান দিকে স্পীডের সঙ্গে ঘোরালো আর সেই ঝটকার চোটে মণি মাসি সামনের সিটের রডের উপর প্রায়: হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলেন।

"এ্যাই ভোলা ঠিক করে চালানা..." লোকটি কথা থামিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।

ভোলা ড্রাইভার আরো চেঁচিয়ে জবাব দিলে,"কী করবো গরখোদা... হঠাৎ একটা ছাগলের বাচ্চা মাঠ থেকে ছুটে রাস্তায় চলে এসেছিল। ওটাকেই তো বাঁচানোর জন্য গাড়িটাকে এমন করে ঘোরাতে হলো।"

মণি মাসির আবার গা ম্যাজ ম্যাজ করছে। হাতব্যাগ হাতড়িয়ে একটা প্যারাসিটামল বের করে বোতল থেকে জল নিয়ে গিললেন। বাড়ি অবধি জার্নিটা ঘুমিয়ে কাটাতে পারলে ভালো হয়।


(পিকটি গুগল থেকে নেওয়া )

Monday, July 18, 2022

ভগাদার সিগন্যাল

আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে ভগাদা রাইট টাইমে আমাগো সিগন্যাল দ্যান।  যেমন এখন সময় আইসা গেসে  এবারে এইটা করতেই হইবো।  আর ফাঁকি মারনের জো নাই।  উদাহরণ দিয়া বুঝাইতাসি মন দিয়া শোনেন থুড়ি পড়েন।  এই উদাহরণগুলা স্ট্রেট-ফ্রম-লাইফ তাই গুল মারতাসি ভাইবলে আপনাগোই  ক্ষতি। 

ঘটনা হইলো এইরূপ  :

শনিবারে আরবান ক্ল্যাপ থিকা ডাকছিলাম একটি মাইয়ারে  । ওই আরকি একটু নিজেকে পরিষ্কার -টোরিস্কার করবো বইল্যা ।  মাইয়াটা আগে কখনো আমার বাসায় আসে নাই.. আমারে দেইখ্যা কয় আপনে তো তিরিশের কোঠায় হবেন। শোনেন মাইয়ার কথা।  আমি তাচ্ছিল্যের হাঁসি হাইস্যা কইলাম আগামী বছর আমি সাইটের ঘরে পাদিমু।  আরে ওই পাদ  নয়। ..আপনেও যেমন। ...অন্য পা।  শুইন্না মাইয়া থ।  হুঁ হুঁ  ...

তার পরে বলি শোনেন :

রবিবারে পায়ের ব্যাথাটা বড্ডো বার বাড়ছিলো।  আমাগো বাসার পিছনে একটি স্পা খুলসে ।  আমার বোনপোর বৌডা কৈল মাসি ভালো কইরা আপনে গিয়া হাঁটুর মাসাজ কইরা আসেন। আমিও ছুট দিলাম। একতলায় স্পা।  বারান্দায় একটি চীনা মাইয়া দাঁড়াইয়া ছিল... আমারে দেইখ্যা ছুইট্ট্যা নিচে আইসা প্রায় টাইন্না উপরে লইয়া যায় আর কি।  উপরে গিয়া দেখি আধো অন্ধকার আধো আলোতে বুদ্ধদেব দাড়াইয়্যা -দাড়াইয়্যা  ঘুমাইতাসেন।  যাইহৌক, আমি অনেক ইনভেস্টিগেশানের পর (ক্যামেরা লাগানো আছে কিনা, ম্যাসাজ ঘরে আয়না আছে কিনা, কার স্পা , কে স্পা করবো এই সব আর  কি) ম্যাসাজ করাইতে রাজি হওয়াতে হাসি খুশি মাইয়াগুলার দন্ত আরও বিকশিত হইলো।  নাগামীজ মাইয়াটা (যারে আগে চীনা ভাবসিলাম) আমার হাঁটুর উপর পিয়ানো বাজাইতে বাজাইতে কত গাল গল্প করলো - তারই মইধ্যে কথা কইতে কইতে একখানা মারাত্মক উক্তি  বড়ই সহজ ভাবে কইয়া ফ্যালাইলো। আমারে কয় কিনা, "যখন আপনারে উপর থিকা দ্যাখলাম আপ্নে বড়ই ইয়ং লাগতাছিলেন  কিন্তু এখন কাছ থিকা  দেইখ্যা আর অত আপনারে ইয়ং লাগতাসে না তো... " আমি অন্ধকারের দোহাই দিতে গিয়াও  দিলাম না। 

আরো শোনেন :

সেই দিনই বিকালে আমাগো হরে রাম, ব্যাটারি -রিক্সা চালক, কাচু মাচু মুখ কইরা আমারে কৈল , "দিদি আপ্নে যাওন লাইগ্যা কোইসিলেন বটে  কিন্তু রিক্সার ব্যাটারিতে চার্জ কম , আপনার ভার  সৈহ্য করতি পারবো না, আপনারে আরেক দিন নিয়া যামু। "

এই ঘটনাগুলার পর খাওয়া-দাওয়া কমায় দিসি।  ভগাদার তাগিদ - এখন ধরিত্রীর উপর বোঝা বাড়াইবার সময় গ্যাসে গিয়া .. বসন্তের ফুরফুরে হাওয়ার মতন শরীরটারে করতি লাইগবো ।  সে সময় আইস্যা গ্যাসে জানি। আপনাগো কী মত ?  কী কন ?

Friday, May 13, 2022

লাছুরি

 

আমার জীবনে কিছু দুক্কু  বরফের ড্যালার মতো জমা পড়ে আছে।  আজ সেগুলির একটা লিস্টি তৈরী করব ঠিক করেছি :

দুক্কু নম্বর ১

এটা আমার ছোটবেলার  দুক্কু 

আমাকে কেউ গান গাইতে বললে আমার স্মৃতি শক্তি ও গলার আওয়াজ দুই ই  লোপ পায়।  "কী গাব আমি কী শোনাবো ..." ছাড়া আর কোনো গান আমার মনে পড়ে না।  অথচ আমার চিরকালের স্বপ্ন  আর ডি বর্মন 'আমাগো  বাসার' সামনের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হারমোনিয়ামে আমার  সা - রে - গা - মা - পা - ধা - নি - সা রেওয়াজ শুনে বাড়ীর কলিং বেল বাজিয়ে আমায় কোলে তুলে নিয়ে একেবারে বোম্বে পাড়ি দেবে। কিন্তু  হলো না ..

দুক্কু নম্বর ২

ইটা আমার মেয়েবেলার  দুক্কু 

কত মেয়েরা কী সুন্দর ভাবে টান -টান করে মডেলের মতন শাড়ি পড়ে , মেক আপ করে , মিষ্টি দেখায়  ...আমি শত চেষ্টা করেও পারি নিকো।  ঠোঁটে লিপিস্টিক মাখলে কালো কালো ছোপ পড়ে।  চোখে কাজল আঁকলে চোখের তলায়  কালি  আরো প্রবল গাঢ় দেখায়। ফাউন্ডেশনের গন্ধ আমার সহ্য হয় না  - মাথা ধরে...গা ঘিন ঘিন করে   তাই এই দুক্কুটাও রয়ে গেলো গো  ...

দুক্কু নম্বর ৩

এটা আমার ধিরে ধিরে গড়ে ওঠা দুক্কু 

ছোটবেলায় আমি ভীষণ  লাজুক ছিলাম।  কেউ কোনো বাজে কথা বললেও তার উত্তর দিতে পারতাম না  - খুব খারাপ লাগতো।  দিনের পর দিন সেই বিষ মাখা কথাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেত।   আর আমি উত্তর না দিতে পেরে মনে মনে গুমরাতাম।  তারপর উত্তর দিতে শিখলাম, রাগ করতে শিখলাম, রাগ দেখাতে শিখলাম এবং শেষ-মেষ রাগে ফেটে পড়তে শিখলাম।  ক্রোধ শনি  ... কে না জানে?  রাগের চোটে  মাঝে মধ্যেই   মাথা দপদপাতে শুরু করতে লাগলো . তখন রাগ কমাবার পন্থা গুলো অবলম্বন করতে শুরু করলাম।  পুরোপুরি ক্রোধ সম্বরণ করতে না পারলেও ভিসুভিয়াস হই  না আর বা হতে হতে থেমে  যাই. কিন্তু আমার দুক্কু হলো কিছু কিছু লোক দেখি কী সুন্দর রাগ চেপে রেখে মিষ্টি মিষ্টি করে  পিচিয়ে পিচিয়ে কথা শোনাতে  পারে তারপর কী অমোঘ কৌশলে ঝোপ বুঝে কোপটি মারে। আমি কেন তা পারিনা ? একদম পারিনা।

দুক্কু নম্বর ৪

 এটা আমার মানে এক্কেবারে এক্সেপশনাল  দুক্কু 

আমি অহেতুক এবং অনিয়ন্ত্রিত অন্তরঙ্গতা বা ভাবপ্রবণতা হ্যান্ডেল  করতে পারি না।  টু মাচ ইমোশন একেবারে নো নো।  মানে ওই ভাবের ফানুশ হয়ে গলে গলে  - ও:! এটা আমার দু:খ না অক্ষমতা ঠিক বলা কঠিন। মানে আমাকে যদি কেউ প্রেম নিবেদন করে - ভাগ্যিস কোনোদিন কেউ করে নি - আমার যে কী  প্রতিক্রিয়া হবে বা হতো  বলা মুস্কিল। একবার এক পাড়ার ছেলে  রাস্তায় আমাকে ,"আপনাকে অনেক কথা বলার আছে কিন্তু কেমন করে বলি বুঝতে পারছি না। .."  বলাতে আমি " তাহলে আর বলে কাজ নেই " বলে হনহনিয়ে চলে গেছিলাম।

দুক্কু নম্বর ৫

এটা আমার বড়বেলার দুক্কু 

আমি অনেক লেটে  গাড়ী চালাতে শিখি।  তার ও বেশ কিছু বছর পরে গাড়ী কিনি।  যতদিনে গাড়ী কেনার মুরোদ হলো ততদিনে গাড়ি চালানো ভুলে গেছি আর কি।  তারপর আবার শিখলাম। দু বার ই ড্রাইভিং স্কুলের গাড়ীতে।  ও গাড়ীতে কেউ চালানো শিখতে পারে না।  কারণ কন্ট্রোল থাকে পাশে বসে থাকা ড্রাইভারের কাছে। তাই আবার শিখলাম - এবার নিজের গাড়ীতে।  তিন মাসের ট্রেনিং ছ মাসে গড়ালো।  যিনি শেখাতেন তিনি টেনশনে টেনশনে বিড়ি ফুঁকে ফুঁকে গাড়ীতে বিড়ির এমন গন্ধ করে ফেললেন যে গাড়ীতে বসা দায়।  এক হরিয়ানার ড্রাইভার আমাকে শেখাতে  এসে রেগে-মেগে বলেছিলো ,"ম্যাডাম আপনি সব জানেন কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে কিছুই করেন না" - ম্যাডাম করবেন কী করে ম্যাডাম তো রাস্তায় নেবে ভয়ের চোটে বোধশক্তিরহিত হয়ে যান ।  আজকালকার ছোট্ট ছোট্ট মেয়েদের দেখি ততোধিক ছোট্ট ছোট্ট জামা পড়ে বিশাল গাড়ী নিয়ে ভোঁ ভোঁ করে চালিয়ে যাচ্ছে।  দেখে হিংসে হয়।  

দুক্কু নম্বর ৬

এটা আমার বুড়োবেলার  দুক্কু  

এই দুক্কু এমন দুক্কু "বোঝে কে আন জনে  সজনি আমি বুঝি মরেছি মনে মনে " - না কাব্যি করার কিছু নেই।  তবে এটা ঠিক যে এই দুক্কু নিয়েই আমি গত হব।  আমি কনজেনিটালি ওভারওয়েট।  ছোট্টবেলায় আমায় কেউ কোলে  নিতে পারতো না।  এখানে ছবি দিতে পারতাম -   থাক।  স্কুল ও কলেজ  এবং পরবর্তি  চাকুরী জীবনে আমি তন্বি হিসেবে খ্যাত ছিলাম।  তিরিশ পেরিয়ে সেই যে খেতাব হারালাম এখন ওইয়িং মেশিনে পা রাখতে ভয় হয় যদি ভেঙে যায় - লজ্জা . লজ্জা।  তবে একবার ডায়েট করে ১৫ কিলো ওজন কমিয়ে ছিলাম।  পাড়া প্রতিবেশীরা চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করতো , "তুমি কী অসুস্থ ?" তারপর শরীর এমন খারাপ হলো - গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট বললেন "ডায়েট করে কাম নাই।  নর্মাল খাবারে ফিরে  আসেন"।  আর আমি সেই যে ফিরলাম আর যাওয়া নাই।  তবে আমার এজেন্ডা না খেয়ে মরার নয় - . আমি খেয়ে বাঁচতে এবং মরতে চাই. - আই হোপ ভগাদা আমার এই ইচ্ছে টুকুর মান রাখবেন। 

যাক অনেক দুক্কের কথা ঢাক পিটিয়ে বললাম  .

 তবে এটা  জরুরি ছিল নয়তো আমার ববম হাজামের মতো অবস্থা হচ্ছিলো। পেট ফুলে ঢোল। 

বয়সটাও এমন .. হঠাৎ করে টেঁসে গেলে ভ্রাম্যমান পেত্নী হয়ে "কাকে বলি...কাকে বলি " করতে করতে মর্তলোকে ঘুরে বেড়াব আর যার তার কানে ফিসফিসাব।  

তাই আর কি লিখে রেখে গেলুম 


হালুম এন্ড হুলুম। 

Wednesday, April 20, 2022

দিশারী



আমার আবার দিক্ভ্রমের বাতিক আছে। 


এই  একটি কারণেই আমি গাড়ী ড্রাইভ করি না বললে ভুল হবে তবে এটা  অনেক গুলো কারণের  মধ্যে একটা ।  যেহেতু  আমার  চলন্ত যেকোনো বাহনে একাগ্রতার অভাব হয় সেহেতু দিক ভুল করা ও যে অসম্ভব নয় তাও নিশ্চিত। এই অদ্ভুত ব্যারামে অনেক ভোগান্তি আমার হয়েছে। কিছু কিছু ঘটনা বলি - 

বাড়ীর কাছের গলিতে ভুল করে ঢুকে পড়ে  ঘুরপাক খেয়েছি বহুবার।  বহুত রাস্তা ভুল করেছি। গলত  টার্ন নিয়েছি। আপনজনদের হাঁসি ঠাট্টার খোরাক হয়েছি।

একবার অটোতে বসে ডান  দিক বলতে বাঁ দিক বলে ফেলেছিলাম। অটো চালক রাগতঃ স্বরে  আমায় নিজের ডান  দিক  বাঁ  দিক ঠিক করে নিয়ে তারপর তাকে ডাইরেকশন দিতে  বলেছিল ।

 একবার রিক্সা করে বাড়ী ফিরছি হঠাৎ মাথাটা গড়বড় করে বসলো। তখন আমি পশ্চিম বিহারে থাকি। এই এলাকার সবচেয়ে বড়  মার্কেট জোয়ালাহেড়ী  থেকে সোজা নাক বরাবর গেলেই জী -এচ ১৪ ব্লকে  আমার বাসা ... কিন্তু কেন জানিনা সব গুবলেট হয়ে গেলো। তখন ভর  দুপুর। রিকশাওয়ালাকে খুব ঘাবড়ে গিয়ে বললাম ভাই আমার বাড়ীটা তো এখানেই ছিল।  কোথায় চলে  গেলো জানিনা। বিহারী রিকশাচালক রসিক ছিল, বললে "সারা দিন পড়ে আছে, খুঁজে নিন। " ভাব ..

তবে তৃতীয় ঘটনাটি মারাত্মক হয়েছিল। ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ নিয়ে রাস্তায় নেমে ছাই রঙা ওয়াগন আর  দেখে দরজা খুলে ড্রাইভারের পাশের  সিটে  বসেই  হুকুম দিলাম, "চল "...গাড়ী স্টার্ট দিচ্ছে না দেখে পাশে তাকিয়ে  দেখি একটি গোল পানা অচেনা মুখ -  শ্যামল বরণ , একজোড়া হৃষ্টপুষ্ট গোঁফ আর বড় বড় বিস্ফারিত  চোখ।  বিস্ফারিত বলবো না -  বিস্মিত  , অভিভূত , রোমাঞ্চিত - সব কিছু মেলানো সেই  লোম খাঁড়া করা দৃষ্টি  কী বলবো আর !!  আমি সেকেন্ডের মধ্যে বাইরে।   

আর একটি ছাই রঙা ওয়াগন আর পিছনে দাঁড়ানো দেখে বুঝলাম কোথায় গন্ডগোলটা করেছি। এর পর থেকে নিজের গাড়ীতে বসার আগে গাড়ীর  নম্বর চেক করার  অভ্যাস করেছি। কিন্তু নম্বরেও যদি গোল করি তাহলে আর কী কী পন্থা আছে এই ব্যারাম থেকে মুক্তি পাওয়ার ভাবতে হবে..

হ্যাঁ ..আরেকটা  কথা 

যেই অচেনা ভদ্রলোকের গাড়ীতে বসে পরম আত্ম-বিশ্বাসের সঙ্গে গাড়ী চালানোর হুকুম দিয়েছিলাম তাঁর স্ত্রী গাড়ীর  কাছাকাছি ছিলেন কিনা জানিনা। একজন আজনবি মহিলাকে গাড়ীতে বসে কিছুক্ষন পরে ছিটকে বেরিয়ে আসতে দেখে তাঁদের বৈবাহিক জীবনে পরবর্তীকালে কোনো গোলযোগ বেঁধেছিলো  কিনা  সেটা জানার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও জানবার কোনো সুযোগ বা উপায় হয়নি । 

হবে কী করে ? ভদ্রলোককে আরেকবার পথে-বিপথে দেখে চিনতেই পারবো না।  তবে হ্যাঁ। .ওনার সেই অবিশ্বাস্য ভরা কেতো -কেতো  চাহনি জীবনে ভুলবো না....... ... সেটা ঠীক।  

Monday, April 18, 2022

বয়:ধর্ম


       
বয়স বাড়ছে ..না: ...হলো না...বুড়ো হচ্ছি বুঝতে পারছি। 

সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার গা এলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে ..বিছানায় 

চা খেতে বসে মনে হয় আরেকটু বসে থাকতে পারলে  বেশ হতো .. সোফায় 

রান্না ঘরে ঢুকে মনে হয় উফ আবার রান্না ..ধ্যুত !

অফিসে না যেতে পারলে কেমন হতো ..ভালোই হতো আর কী ?

গাঁটে গাঁটে নানা প্রকারের ব্যাথা বেদনার কথা নাই বা পারলাম ..

অনেক কিছু আগে খেতে ভালো লাগতো .. রসিয়ে রসিয়ে রান্না করে  আঙ্গুল চেটে খাওয়া  - উঠে গেছে। পেটে   সয় না .

আয়নার  সামনে  অনেকক্ষণ  ধরে  দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে ভালো লাগতো  নানান এঙ্গেলে ... এখন চুলের পাক ধরাটা বেশি নজর কাড়ে ..সরে আসি।  কাকে দেখছি ? এই কি সেই আমি????

খুব তাড়াতাড়ি  বিরক্ত  হয়ে যাওয়ার বাতিক  হয়েছে..মনে হয় চুপ করে বসে থাকি ..ওই লোকটা কী যে ঘ্যান ঘ্যান করছে  .... সে যেই হোক না কেন 

একটা ভয় ঢুকেছে . এর পরে কী হবে ..আজ যেটা করতে পারছি কাল যদি না পারি তবে ?

নার তালিকাটা লম্বা হয়ে যাচ্ছে ..

দুপুরে নাক ডেকে ঘুমোবার স্বভাবটা চিরকালের।  এখন সেটা বিপজ্জনক লেভেলে  দাঁড়িয়েছে। যেকোনো সময়  যেখানে ইচ্ছে। 

সে যেখানেই হোক ঘুমে ঢুলে পড়তে দেরি  লাগে না।  একদিন তো ক্যাবে..  ড্রাইভার মশাই আগেই দর দস্তুর করে নিয়েছিল - সিএনজির দাম বেড়েছে।  আপনি যদি এসি চান তাহলে আমাকে ডাইরেক্ট পেমেন্ট করে দিন. আমি বললাম না এসির দরকার নেই. বলতে বলতেই ঘুমে ঢুলে পড়লাম। গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে "প্রখর তপন তাপে ..এ .এ .এ " এমন ভাবে নাক ডাকিয়ে কেউ ঘুমোতে পারে ক্যাব চালকের বোধহয় ধারণার বাইরে।  অনেকবার ধুম ধুম করে ব্রেক কষেও  জাগাতে না পেরে গম্ভীর মুখে আমায় অফিস অবধি ছেড়ে দিয়ে বোধ করি  স্বস্তির নি:শ্বাস ছেড়ে বেঁচেছে। 

আরও অনেক এরকম ছোট ছোট ব্যাপারে বুঝতে পারি পৃথিবীতে অনেক দিন কাটিয়ে ফেলেছি। 

কিন্তু এখনো "সাধ  না মিটিল আশা না পুরিলো সকলি ফুরায়ে যায় মা ..আঁ  ..আঁ  ..আঁ "

গলায় আজকাল  তেরোটা সুর খেলছে  - এ টা আরেকটা ইন্ডিকেশন..

এবার  রাখি 

আর বোর  করবো না। 

Tuesday, April 05, 2022

অপরাহ্নে



যাদের  দুপুরে নাক ডাকিয়ে ঘুমোবার ব্যারাম আছে এই লেখাটি তাদের জন্যে ..


শিতের  দুপুর 


ঘুমের আবেশ 

"লেপের আদরে "

সন্ধ্যে নামে নি:ঝুম সুর 



বসন্তের দিন 


কোকিলের  তান 

"সুবাস শয়ান" 

 অলস রঙ্গীন 


তপনের তাপ

 

শীতল বাতাসে 

আধো আঁধারে 

স্বপ্নের ঝাঁপ 


হেমন্ত রাগ 


মেঘের পালকে 

স্নিগ্ধ আমেজ

আকাশের নীল 

শুভ্র সুনীল 

ঝিরঝিরে হাওয়া 

হুতাশের হাঁক 


আবার পরশ 

হিমের অবশ 

করা সেই দিন

স্বপ্ন বিহীন 




অপরাহ্নের কত না   রূপ 


Monday, April 04, 2022

কুঞ্চি-বুঞ্চির মা ডেপি




"আরে ! কী  খবর ? কেমন, ভালো তো ?"

"হু:! আর কী  ভালো?"

"কেন ? আবার কী  হলো ?"

"হলো মানে ? আপনি জানেন না?"

"কই  না তো ?"

"এঃ ? কোথায়  থাকা হয় মশাইয়ের ? কোনো খোঁজ খবরই  রাখেন না দেখছি।  পাড়ায়  কী  হচ্ছে না হচ্ছে .....যায় আসে না বুঝি ?"

"যায় আসে না মানে? যায় আসবে না কেন বলছেন?"

"বা রে ! এতো বড়ো কান্ড ঘটে গেলো আর আপনি কী মশাই খোঁজই রাখেন না। "

"আরে কী মুশকিল ! কী হলো তা না বলে আবার সেই আবোল তাবোল..."

"শুনবেন ? শুনতে চান?"

"হ্যাঁ ! হ্যাঁ রে হ্যাঁ ! বলুনই  না কী ব্যাপার... "

"তবে শুনুন..আমাদের ডেপি ..কী বলবো মশাই ..ছ্যা: ছ্যা: ...শুনে অবধি...কী বলবো আর (গলা নামিয়ে) ডেপি আমাদের পোয়াতি হয়েছে।  কী  কেচ্ছা ... কী  কেচ্ছা !"

"ছেলেটি ক্যাডা ?"

"সে তো বেপাত্তা। "

"এ: ? কী বলেন মশাই ?

" তাও জানেন না মশাই ? আপনাকে নিয়ে আর পারা গেলো না।  এত  বড় একটা কান্ড ঘটে গেলো পাড়ায়  আর আপনি...."

"কী করবো বলুন ? চাকুরে মানুষ।  সকালে বেরিয়ে রাত্রে ফিরি। কী  করেই বা এতো খবর রাখি বলুন ? তা মা আর বাচ্চা ভালো তো? দেখাশোনার ভার তাহলে কে বা করা...."

"আরে ছাড়ুন মশাই।  আবার দেখাশোনা। সারা পাড়া  দেখা শোনা করছে।"

"সারা পাড়া ? সমাজের তাহলে উন্নতি হয়েছে বলুন। সবাই মিলে  যখন  ভার সামলাচ্ছে তখন  সামাজিক দায়দায়িত্বর  মাপ বেড়েছে।  কী বলেন ?"

"এঃ ?" কিছুক্ষন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে , " কী যে বলেন ?শুধু মা নাকি ? তার আবার দু দু খান...আমার উনি আবার আদর করে নাম রেখেছে কুঁচি আর বুঁচি।  উফ আর পারি না। "

"বা: ! খুব সুন্দর  মিষ্টি নাম..."

"হু:"

"তা অন্নপ্রাশন টাশন   কবে?"

"এ:...? কুকুরের বাচ্চার আবার অন্নপ্রাশন ? আপনার মাথা খারাপ নাকি?"

"কু..."

"আপনি  কী ভাবলেন মানুষের? ছো :...ছো: ..."

"উফঃ!  আগে বলবেন তো। তখন থেকে।"

"তবে আরেকটা খবর আছে ," গলা খাটো করে , "সেটা কিন্তূ  মানুষ 
সংক্রান্ত .."

"আরেকদিন শুনবো দাদা।  একটু তাড়ায়  আছি। অফিস যেতে  হবে... চলি। "

হন হন করে এগিয়ে গেলেন।

"যা বাব্বাঃ !" মাথা নাড়তে নাড়তে , "কেমন ধারার লোক।  কুকুরের গল্প এতক্ষন ধরে মন দিয়ে শুনলো।  আসল  কথা শোনার সময় কাজের তাড়া।  হু:..."