Wednesday, February 14, 2024

বীণাপাণি পুস্তকহস্তে দেবি নমস্তে

আজ সরস্বতী পুজো। 
বেশি কিছু লিখছি না।
শুধু কয়েকটা ছবি আপলোড করছি।

সকাল সাড়ে দশটায় বেরোলাম অঞ্জলি দিতে। নিবেদিতা এনক্লেভ কালি বাড়ি।
পৌঁছতে পৌঁছতে এগারোটা।
শুধু চা খেয়েছি আটটা নাগাদ।
উপোষী বলা চলে।
মা শুভ্রবসনা। কিন্তু প্যান্ডেলের ছাত লাল। তাই রোদের আলো লাল হয়ে গিয়ে সব ছবি লালছোঁয়া হয়ে গেছে।

মাকে একলা পাওয়া যাচ্ছিল না। অঞ্জলীর দল। মা মাসীর দল। তারই মাঝে একবার ঝপ করে ক্লিক করলাম।

মা মাসীদের পার্টিসিপেশন বেশি। বাচ্চাদের, পড়ুয়াদের দর্শন বিরল। 

এবার একটু নতুন ডেকরেশনের ছোঁয়া। মন্দির দ্বারের দু ধারে দুই বিবর্ণ পড়ুয়া বর্ন পরিচয় হাতে।
বিদ্যাসাগর মশাইকে অনেকদিন পর সশ্রদ্ধ নমনে।মনটা মজা পেল । হ্যাপি হলো।

শুধু খবর কাগজ দিয়ে তৈরি। অভিনবত্ব আছে।

বাড়ি এসে দিদির হাতের খিচুড়ি আর চাটনি খেয়ে মন  তৃপ্তি পেল।

তারপর  লম্বা ঘুম । 

Monday, February 12, 2024

সিলুয়েট

সেকালে কোনো ফ্যান্সি ক্যামেরা ছিল না।  ছিল না দামী মোবাইল।  নিত্য নতুন টেকনোলজির চল হয়নি।  সেই সময় আমার পিশেমশাইকে সাদামাটা ক্যামেরায়ই  দারুন অ্যাঙ্গেলে সাদা কালো ছবি তুলতে দেখেছি। অ্যালবাম ভর্তি। পিশেমশাইয়ের ছিল ঘোরার শখ আর ছবি তোলার।  ওঁর তোলা ছবি আমার কাছে খুব কম আছে। তাই ওনার কৃতি তুলে ধরতে পারলাম না।

আমাদের পরিবারে আর এক গুণী ব্যক্তিত্ব ছিলেন আমার সেজো মামা। তিনি খুব ভালো তবলা বাজাতেন তাই আমার মামাতো মাসতুতো ভাই বোনেরা ওনাকে ধিন মামা বলে ডাকতো। মা ডাকতেন দাদামনি বলে। তাই আমি আর দিদিও ওঁকে দাদমনি বলে ডাকতাম। দাদামনি যেকোনো গান শুনে ঝটপট হারমোনিয়ামে তুলে ফেলতে পারতেন। উনি ভালো খেলোয়াড় ও ছিলেন - ব্যাডমিন্টন, তাস, ক্যারাম ইত্যাদি। কিন্তু সবচেয়ে জবরদস্ত ছিল ওনার গল্প বলার টেকনিক -  যাকে আজকালকার দিনে বলে আর্ট অফ্ স্টোরিটেলিং। 

উনি আমাদের বাড়ি আসলেই ওনাকে আমরা ছেঁকে ধরতাম গল্প শোনানোর জন্য। ওনার মুখেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক লেখক লেখিকাদের গল্প শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। হয়তো ওনার কাছ থেকেই গল্প শুনতে শুনতে গল্প লেখার বা বলার নেশা অজান্তেই আমায় বশ করেছিল । ফ্রেঞ্চ লেখক মোপাসার লেখা প্রচুর ছোট গল্প ওনার মুখেই শোনা। গল্পের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর জায়গাটিতে উনি ইচ্ছে করে ব্রেক নিতেন আমাদের উত্তেজনা ও গল্পের সেই মোড়টির পরে কি হবে জানার প্রবল ইচ্ছেটিকে প্রবলতর করার জন্য। সিগারেটে একটি সুখটান দিতে দিতে ফরমায়েশ করতেন এক কাপ চায়ের। যতক্ষণ চা না আসত ততক্ষণ গল্পে বিরতি আর সেই মুহুর্তে আমাদের উদগ্রীবতা চরম পর্যায়ে পরিণত হতো । সে কি এক্সাইটমেন্ট! আধুনিক যুগে পী ভী আর, ইউ টিউব, ও টি টি তে অভ্যস্ত বাচ্চাদের অবশ্য আমাদের কেবল প্রাচীন রেডিও ব্যতীত অন্য কোনো মনোরঞ্জন  ও এক্সপোজারের মাধ্যম না থাকার দরুন কথকের সামনে বসে রসিয়ে রসিয়ে তাঁর গল্প বলা ও আমাদের মুখ হা করে শোনার তাগিদ কল্পনা করা কঠিন।

দাদামনির আরেকটি হবি ছিল ফটোগ্রাফি। 

তখনকার দিনে ভালো ফটোগ্রাফি কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। ছবি তুলতে গেলে ঠিক সময়, পর্যাপ্ত আলো, সঠিক অ্যাঙ্গেল ইত্যাদির খেয়াল রাখতে হতো। সেকেলে ক্যামেরার লেন্স অ্যাডজাস্টমেন্ট করাই ছিল বিরাট কসরত।

দাদামনির তোলা মা এবং মাসীর (দুজনেরই বিবাহের পূর্বে) এই ছবিটি আমার খুব প্রিয়। বাবা বলতেন এটা সিলুয়েট। খুব কঠিন ফটোগ্রাফি। এখানে ওনার কৃতি তুলে ধরলাম আপনাদের জন্য।

তবে দু:খের বিষয় পিসেমশাই ও দাদামনি দুজনেরই ব্যক্তিগত জীবন সুখের ছিল না। সে গল্প আরেকদিন।


ছবিটি একটি পুরোনো পারিবারিক অ্যালবাম থেকে নেওয়া। মেইনটেন্যান্স নেই তাই নষ্ট হতে চলেছে। কেমন ভাবে ছবিটিকে বাঁচিয়ে রাখা যায় ভাবছি। আপনাদের কোনো পদ্ধতি জানা থাকলে নিশ্চই কমেন্টে লিখে জানাবেন।

শুভ রাত্রি।

Tuesday, January 23, 2024

বসে আছি পথ চেয়ে

চুপচাপ ।

বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা।

কুয়াশায় ঘেরা।

ধোঁয়াটে।

কাঁচের জানালাটা মাঝে মাঝে জলের ধারায় ভিজে যাচ্ছে। যেন বৃষ্টির ধারা ঝরে পড়ছে। আসলে কুয়াশা জলের ধারায় পরিণত হচ্ছে । আর কিছুই নয়।

এইরকম আবহাওয়ায় হিটারের সামনে বসে ভুতের গল্প বা রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস বা টিভিতে এরকম ধরনের সিনেমা বা সিরিজ দেখার মরশুম।

কিন্তু কিছুই করছি না।

পায়ের মোজাটা ভিজে ভিজে লাগছে।

কেন?

আমি তো জলে যাইনি।

তবে?

ঝুঁকে দেখি একরাশ রক্ত।

পায়ের তলার দিকটা।

মোজা ভিজে গেছে।

না কোনো রক্তাক্ত খুনের সীনে পায়ের ছাপ ফেলে ( জুতো ছাড়া ?) আসিনি।

কাউকে রাগের বসে নিশুতি রাতে ঝোপ বুঝে কোপ মারিনি।

তবে?

চিল ব্লেন...

কনকনে ঠান্ডায় পায়ের আঙুলগুলি ফুলে চুলকুনি হয়। চুলকে চুলকে ফেটে রক্ত বেরোয়। 

তারেই কয় চিল ব্লেন ।

ওই আর কি!

এই হাঁড় কাঁপানো জানুয়ারি মাসের শীতে বাড়িতে আটকে থেকে একটা রোমহর্ষক পরিস্থিতির সুচনা করলাম।

আর কি!!!🤪🤪

 

এখন একটু খানি রোদের ঝলক দেখা গেছে।

দেখা যাক কতক্ষন থাকে।

ঠান্ডা কমে কিনা।

তার সঙ্গে চিল ব্লেন । 🤞🤞


#বাংলাব্লগ #আজকেরডায়েরি #শীত #রক্তাক্তব্যাপার #রোমহর্ষক



                                                                                                                             


                                                                                                             



                                                                                                             


Sunday, May 28, 2023

অবিনাশ বাবুর হবি



অবিনাশ বাবু ছাপোষা লোক। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কেরানির কাজ করছেন বহু বছর ধরে। অবিবাহিত তাই কোনো হুজ্জুত নেই। সপ্তাহে পাঁচ দিন নটা টু পাঁচটা অফিস। শনিবার সকালে একটা স্কেচ বুক নিয়ে বেরিয়ে পড়া। হ্যাঁ - অবিনাশ বাবুর এই এক হবি। যত অজানা, অচেনা মফঃস্বল, গাঁয়ে, গঞ্জে ঘুরে ঘুরে ভাঙ্গাচোরা বাড়ি খুঁজে বার করা, যেই বাড়িতে কেউ বসবাস করে না - পরিত্যক্ত; তার ছবি আঁকা;  শুধু ছবি আঁকা নয় - সেই বাড়িটি যদি আবার নতুন করে গড়ে তুলতে হয় তাহলে তার রূপ কেমন হতো বা হতে পারে - মানে আগাগোড়া নতুন -  প্রত্যেকটা ঘরদোর, বারান্দা, রান্নাঘর, বাথরুম ইত্যাদি - তার ও স্কেচ তৈরি করা।

এককালে অবিনাশ বাবুর আর্কিটেকচার নিয়ে পড়াশোনা করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু যৌথ পরিবারের দায়িত্ব, অভাব অনটন, ওই যা হয় আর কি। কিন্তু অবিনাশ বাবু ওনার কলেজ জীবনের আকাঙ্ক্ষাকে হবি বানিয়েই এখন পরিতৃপ্ত। পয়সাও বেশি খরচ হয় না আবার প্যাশনেরও খিদে মেটে। মানে একটা মাঝপথ বেছে নেওয়া এই আর কি। এই মাঝপথই মধ্যবিত্তদের মেরুদন্ড - সমঝোতা, অ্যাডজাস্টমেন্ট, কম্প্রোমাইজ - করেই সন্তুষ্ট থাকা।

এই সপ্তাহান্তে অবিনাশ বাবু পাড়ি দিলেন বেশ কিছুটা দুরে। গুগলে দেখে। ট্রেনে করে চাকদা। তারপর বাসে করে অক্ষ নামে এক অজ গ্রাম। সেখান থেকে সাইকেল রিকশা করে তালিপুর। তার আগে কোনো বাহন যায় না। তাই হাঁটা দিতে হলো। অবিনাশ বাবুর তাতে কোনো আপত্তি নেই। আজ ভোরে বৃষ্টি হওয়াতে গরম বেশ কম। ফুরফুরে হাওয়া ও দিচ্ছে। অবিনাশ বাবু এরকম বহু পায়ে হেঁটে সফর করেছেন। এবার অবশ্য একটু বেশি হাঁটতে হলো। 

ধু ধু করছে মাঠ। মাঠ যেখানে শেষ সেখানে বাড়িটা শুরু। একেবারে ঝরঝরে। দরজা জানালা বলতে প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। আছে শুধু বাড়িতে ঢোকার গেটটা। গেটের উপর একটা গাছ ঝুঁকে পড়েছে। কামিনী ফুলের বোধহয় । ফুল হয় কি হয় না কিন্তু গাছটা আছে। গেটের সামনে একটা ভাঙ্গা রোয়াক। অবিনাশ বাবু রোয়াকে বসে গেট দিয়ে উঁকি মারলেন। বেশ অনেক খানি জায়গা পেরিয়ে কিছু ধাপ সিড়ি উঠে গেছে। মোটা মোটা থাম দিয়ে ঘেরা বারান্দায়। থামগুলো যে এখনও দাঁড়িয়ে আছে দেখে অবিনাশ বাবুর অবাক লাগলো। খালি জায়গাটায় এক সময় মনে হয় বড় একটা পুকুর ছিল। সেই পুকুর ঘিরেই বাড়িটা। 

অবিনাশ বাবু অনেক ক্ষন বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। এত বাড়ি ঘেটেছেন, এঁকেছেন, আগাগোড়া নতুন ভাবে গড়বার চেষ্টা করেছেন কিন্তু এই বাড়িটার একটা আলাদা ব্যাপার আছে। ব্রিটিশ আমলের তো বটেই তার ও চাইতে পুরোনো হতে পারে। এখনও যে টিকে আছে এটা আরেকটা আশ্চর্য। তাছাড়া এই রোয়াকে বসে অবিনাশ বাবুর কেমন একটা আচ্ছন্ন ভাব ঘিরে ধরছে। মনে হচ্ছে যেন -

"সো ইউ হ্যাভ  অ্যারাইভড" - অবিনাশ বাবু চমকে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলেন একজন খ্যাংরা কাঠির মতন ঢ্যাঙা লোক দাঁড়িয়ে মুচকি হাঁসছে । পরনে তার ময়লা, অনেক বছরের পুরনো , বহুল ছিদ্রযুক্ত গেঞ্জি আর ততোধিক ময়লা ও ছিদ্রযুক্ত ধুতি ল্যাঙ্গটের মতন করে জড়ানো। কিন্তু চোখের চাহনিটি প্রখর, বুদ্ধিদীপ্ত। আর ইংরিজিটা তো এ্যাকেবারে পারফেক্ট প্রায় ইংরেজদের মতন। গলার স্বরটা ও গম্ভীর তবে ঠোঁটের কোণের হাঁসিটি শিশুসুলভ।

এ বাড়িতে যে কেউ বাস করে অবিনাশ বাবুর জানা ছিল না। উনি নিতান্তই অপ্রস্তুত ভাবে সেটা জানাতে লোকটি প্রাণ খুলে হা হা করে হেঁসে বলল,"সেটা কোনো ব্যাপার নয়। অনেকেই হয়ত এটা জানেনা। আর আপনার গুগল বাবাজির তো একদমই জানার কথা নয়। তবে আপনি আপনার কাজ চালিয়ে যান। স্কেচটা কি কমপ্লিট?"

অবিনাশ বাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, " আপনি কি করে জানলেন আমি স্কেচ করতে এসেছি?" ভদ্রলোক অবিনাশ বাবুর কোলের উপর রাখা খোলা খাতাটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন। অবিনাশ বাবু ভুলে গেছিলেন কখন ভাবতে ভাবতে উনি খাতাটা খুলে ফেলেছেন। 

" না , এখনও শুরু করিনি। জায়গাটা ফীল করছিলাম।"
লোকটি পাশে এসে বসে মাথা নাড়লো, " এই বাড়ির লম্বা ইতিহাস। বুঝলেন অবিনাশ বাবু।"

অবিনাশ বাবুর আবার অবাক হওয়ার পালা। "আমার নামটা....?"  উত্তরে মুচকি হাঁসি আবার স্কেচ বুকের দিকে আঙুল দেখানো। "যখন কাজ আরম্ভই হয়নি তাহলে আগে একটু চা হয়ে যাক। তবে এখন কিন্তু দ্বিপ্রহরের খাবার সময়। "

অবিনাশ বাবু মোবাইলে দেখলেন সময় বারোটা পঁয়তাল্লিশ। সত্যিই তো এতখানি সময় কেটে গেছে উনি খেয়ালই করেননি ।

"তাহলে রান্নাটা চাপিয়ে চায়ের ব্যবস্থা করে আসি।" শত মানা করা সত্বেও ভদ্রলোক শুনলেন না। " আমি কিন্তু ভালো রন্ধন জানি। একটু সময় লাগবে। তবে তার আগে চা। " বলে লোকটি উঠে গেট দিয়ে ঢুকে বারান্দায় থামের আড়ালে যেন মিলিয়ে গেল।

অবিনাশ বাবু বসে রইলেন। এই প্রথম তাঁর স্কেচ বানাতে ইচ্ছে করছে না। এটাকি এতটা পথ হেঁটে আসার ক্লান্তি? না: বাড়িটার একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অবিনাশ বাবুকে বার বার আচ্ছন্ন করে ফেলছে। মনে হচ্ছে যেন চোখের সামনে অনেক রকমের দৃশ্য দেখছেন। যখন এই বাড়িতে বসত ছিল। লোকেদের আনাগোনায় ভরপুর। এই মাঠটা যখন জনপদ ছিল। ঘোড়ার গাড়ির শব্দ। দারোয়ানের হাঁক। বাবুদের পায়ের জুতোর মচমচে আওয়াজ সিড়ি বেয়ে নেমে আসছে ।

ভদ্রলোক দু খুঁড়ি চা নিয়ে হাজির। কাপ নয় । গেলাস নয়। খুঁড়ি । অবিনাশ বাবু অবাক হওয়ার ক্ষমতা ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। চুমুক দিলেন। চাটি চমৎকার। দামী, সুগন্ধি চা। 

"কি স্কেচ হলো?" ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন ।

অবিনাশ বাবুর না শুনে উনি আবার মাথা নাড়লেন।

"এই বাড়ির অনেক দিক আছে। একদিনে আপনার স্কেচ তৈরি হবে না। আপনি বরং দু এক দিন থেকে যান। ঘুরে ফিরে ভালো ভাবে দেখুন তারপর না হয় আঁকবেন।"

অবিনাশ বাবু অফিসের অজুহাত দিয়ে মানা করতে, ভদ্রলোক কথাটা "অফিস থেকে ছুটি ও তো নেওয়া যায়" বলে একদম উড়িয়ে দিলেন। অবিনাশ বাবুকে বাইরেটা ভালো করে ঘুরে দেখে স্কেচটা কিরকম বানাবেন তার আইডিয়া নিতে আর "আমি রান্না সেরে আসছি" বলে আবার থামের আড়ালে উধাও হলেন।

অবিনাশ বাবু বেশ কিছুক্ষণ বসে থেকে ঠিক করলেন আর না। স্কেচ আজকেই মোটামুটি শেষ করে বাড়ি ফিরবেন। আবার না হয় আরেকদিন ভদ্রলোকের আতিথেয়তা গ্রহণ করা যাবে। তবে এই ভগ্নাবশেষ ভবনে অতিথি সেবার কি করে ব্যবস্থা হতে পারে অবিনাশ বাবুর বোধগম্য হলো না।

মোবাইলে দেখলেন বিকেল চারটে। ভদ্রলোক বেশ কিছুক্ষণ হলো ভেতরে গেছেন। অবিনাশ বাবুর  পেটে একটা কুনকুনে ব্যথা উঠছে। অনেক ক্ষণ না খেলে পেট খালি থাকার ব্যথা। সেই ভোর পাঁচটা নাগাদ এক কাপ চা আর দুটো মারি বিস্কিট খেয়ে বেরিয়েছেন। সাধারণত: পথেই কোনো দোকানে অবিনাশ খেয়ে নেন। কিন্তু আসার পথে এমন কোনো দোকান ও পড়েনি আর অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় খাবার কথা মনেও ছিল না। 

অবিনাশ বাবু কাঁধের ঝোলায় হাত গলিয়ে পেন্সিল আর রাবার টা বার করলেন। এই যা:!পেন্সিলটা যে এক্কেবারে নতুন। ছোলা হয়নি। ব্যাগে হাত গলিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করে ও সার্পনারটা পেলেন না। কাটারটা ও তাড়াহুড়োতে আনতে ভুলে গেছেন । এখন একমাত্র বিকল্প বাড়ির ভেতরে ঢুকে রান্নাঘর থেকে একটা ছুরি চেয়ে নেওয়া। অবিনাশ বাবু পা বাড়ালেন।

বাইরে সূর্য্য পশ্চিমের দিকে হেলে পড়েছে। তবু ও আলোর রেশ আছে কিছুটা। দালান পেরিয়ে ভিতরটায় ভীষনই কম আলো। অনেক গুলো ঘর। রান্নাঘরটা কোন দিকে অবিনাশ বাবু অনেক ঘুরেও ধরতে পারলেন না। বাড়ি নয় যেন ভুলভুলইয়া । একবার ভাবলেন বেরিয়ে পড়া যাক। আজ এখানেই ইতি। কিন্তু অবিনাশ বাবুর সেটা স্বভাব বা এতদিনের অভ্যাস বিরুদ্ধ। হঠাৎ খুক খুক করে কাশির আওয়াজ এলো ।অবিনাশ যেখানে দাঁড়িয়ে ঠিক তার বাঁ দিকে। এগিয়ে যেতেই দেখলেন ঠিক ধরেছেন। এটাই রান্নাঘর আর ভদ্রলোক একটি মাটির উনুনের সামনে উবু হয়ে বসে আছেন। উনুনটি কিন্তু নেভানো। আদৌ জ্বালানো হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। সারা ঘরে রান্নার কোনো সামগ্রী বা বাসনপত্র নেই। রান্না হয়েছে বলে মনেই হয় না। 

ভদ্রলোক স্মিত হেসে আপ্যায়ন করলেন। যেন জানাই ছিল যে অবিনাশ আসবেন। " আসুন! আপনি ঠিক জায়গায় এসে পড়েছেন।" 

"না মানে একটা ছুরি হবে। পেন্সিল কাটারটাই আনতে ভুলে গেছি।" অবিনাশ লজ্জিত হয়েই বললেন।

"হ্যাঁ! সব আছে। ছুরি, কাঁচি, দা। এই নিন " বলে ভদ্রলোক হাত বাড়ালেন। তাঁর হাতে চকচকে একটি ছুরি যেন এখনই শান দেওয়া হয়েছে। আর ছুরির গাঁয়ে ওটা কি লাগা - কালচে লাল রং? রক্ত না! 
আর ঠিক সেই সময় ঘর অন্ধকার কর সুজ্যিদেব টুপ করে আকাশের পশ্চিম কোনে ডুব দিলেন।

***

অবিনাশ বাবুর সেবার স্কেচ করা হয়েছিল কিনা জানিনা তবে দু সপ্তাহ আগে খবরের কাগজে একটি ছোট পুলিশী বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছিল।

নাম - অবিনাশ সেন
বয়স - ৪০ বছর
উচ্চতা - ৫.২"
গায়ের রং - ফর্সা
নাকের ডান পাশে একটি আঁচিল আছে
পরনে - কালো প্যান্ট আর সাদা বুশ শার্ট
মানসিক স্তিথি - সুস্থ
শনিবার ৮ই এপ্রিল ২০২৩ থেকে নিখোঁজ

একটা ছবিও দেওয়া ছিল। এই ব্যক্তিটির কোনো খবরাখবর পেলে অমুক থানায় জানাতে। 

আপনারাও একটু খেয়াল রাখবেন। ভদ্রলোকের কাঁধে  ঝোলায় একটা স্কেচ বুক, নতুন পেন্সিল আর রাবার পেলেও পেতে পারেন। এঁকে শেষ তালিপুর, চাকদা জেলার আশেপাশে দেখা গেছে।

***


Tuesday, May 23, 2023

রহস্য ! কেমন?


নখ খুঁটতে খুঁটতে বা কাঠের ফ্লোরে এক্কা দোক্কা খেলতে খেলতে যদি খুনের রহস্য সমাধান করা যায় তবে ব্যাপারটা কিরকম দাঁড়ায়?

বলছি...

পাহাড়ের কোলে নির্জন কুয়াসায় আচ্ছন্ন বনের মাঝে একটি ছিমছাম রিসর্ট। নাম অনন্যা। মিতা আর কুণালের স্বপ্নের প্রতিবিম্ব। এক্কেবারে নতুন না হলেও বেশি লোকের আনাগোনা নেই। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটে বিজ্ঞাপন দেখে লেখক অনিমেষ (অর্জুন চ্ক্রবর্তী) নিরিবিলি পরিবেশের সন্ধানে থ্রিলার লিখবেন বলে বুকিং করালেন। যাওয়ার পথে স্কুলের বন্ধু , বর্তমানে  বর্ধমানের এস পি , কিঞ্জল দাশের সঙ্গে দ্যাখা। দুজনেই অনন্যায় ছুটি কাটাতে যাচ্ছে। কাকতালীয় আর কি!

একে একে  অন্য অতিথিদের প্রবেশ। কুহেলী মিত্র ও দামিনী রায় (সোহিনী সরকার)। জিউ আর টনি কিন্তু আগের থেকেই রিসর্টে মজুদ। এস পি দাশের বুকিং টা প্রায় ক্যানসেল হতে হতে রয়ে গেল। আরেক অতিথি দীপক মালহোত্রা লাস্ট মিনিটে ঢপ দিল। আর কি ? বুকিং কনফার্ম। 

তারপর যা হয়। রাতের অন্ধকারে বাতি চলে যাওয়া আর কুহেলী মিত্রর খুন ! তাও আবার সাতাশ দফা  ছুরিকা ঘাতে। খুনি আনপ্রফেশানালি মার্ডার ওয়পেন্টা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিতেই গোয়েন্দা দামিনী রায় সেটা টপ করে  ক্যাচ করে ফেললো। 

একে অন্যকে এই পরিস্থিতিতে সন্দেহ করবে না  কখনো হয়? তার উপর রোমাঞ্চ ঘনীভূত করার জন্য পাহাড়ে ধ্বস নামা, মোবাইলে নেটওয়ার্ক না থাকা, আলো না আসা (মাঝে মাঝে অবশ্য কোনো কোনো সিনে বেডসাইড ল্যাম্প জ্বলছিল) ,অন্ধকারে ছায়ার মতন ঘুরে বেড়ানো ( কেন বাবা?)। বেশ কয়েকটা এপিসোড তাই আরেকটা খুন হওয়া বাঞ্ছনীয়। এবার হলো মিতা। কি পুডিং না পায়েস এক চামুচ খেয়েই ধপাস করে সোফা থেকে উল্টে পড়ে শী পিকড পটল।

এই সময়  হঠাৎ পুলিশ কোথেকে এসে হাজির। এতক্ষণ কিঞ্জল  কতো হ্যালো হ্যালো করলো তখন তো বাপু এলে না। আর দামিনী রায় ডাকার সঙ্গে সঙ্গে ... ভেরি ব্যাড । যাই হোক পুলিশ কিন্তু  দুটোর জায়গায় একটা বডিই উদ্ধার করতে পারল। মিতার বডি লোপাট। কি আর করা।

কিন্তু সেই রাতেই মিতার ভুত হঠাৎ আয়েগা আনেওয়ালা স্টাইলে গান ধরলো। ব্যাস আততায়ী  বিস্ময়ে বিস্ফারিত নেত্রে কবুল করলো, "হাউ কম ইউ আর হিয়ার? আমি তো তোমাকে  মারলাম কিছুক্ষণ আগে।" আর কোথায় যাবা? ক্যাচ কট কট।

আমার টুইটার বন্ধু দীপাঞ্জন বললেন এই ওয়েব সিরিজটা নাকি সাদা কালো পুরোনো ছবি "চুপি চুপি আসে" র ছায়া অবলম্বনে। দেখে ফেললাম। ভালো লাগলো। আবার ওই ছবিটি আগাথা কৃষ্টির থ্রি ব্লাইন্ড মাইস অবলম্বনে। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো? 

যাই হোক আমার বাজে রিভিউ লেখা স্বভাব তাই মাফ করবেন। যারা মার্ডার মিস্ট্রি পছন্দ করেন তারা দেখতে ছাড়বেন না । হইচইতে স্ট্রিম করছে।

তবে ইয়ে মানে আমার খুঁতখুঁতেমি আর কি। "শুধু দুটো প্রশ্ন কোনো কথা নয় " :

গোয়েন্দাদের সব সময় পাগলাটে দ্যাখায় হয় কেনো? বেশি ইন্টেলিজেন্ট বলে। তার মানে আমি যে বিদ্যাধরী তাহলে কি আমিও একটু.... ধ্যাৎ নট পসিবল।

কিন্তু খুন হবার আগেই খুন হবে খুন হবে  টাইপের শোকাশুকি করে রাতের অন্ধকারে সারা রিসর্টময় দামিনী রায় কেনো ঘোরাঘুরি করছিল বুঝলাম না।

আর যেই পুলিশ পাহাড়ি ধ্বসে আটকা পড়েছিল সেই পুলিশ দামিনী রায় সিটি মারতেই কি করে হাজির হলো?

এই রে তিনটে প্রশ্ন হয়ে গেল। 

সরি।

আমার শমিক্ষা কে অগ্রাহ্য করে দেখে ফেলুন #হোমস্টেমার্ডার

আচ্ছা রিসর্টের নামটা তো ছিল অনন্যা তাহলে হোমস্টে....মানে কি করে?




ছবির ক্রেডিট আমার ভীষন ভালো আঁকিয়ে বান্ধবী অঙ্কিতা শর্মার

Wednesday, March 29, 2023

রাম রাম







কালী কালী মহাকালী কালীকে পাপনাশিনী
ধর্মার্থ কাম মোক্ষার্থ   কালিকায়ই  নমস্তুতে



এই মন্ত্রটা মনের মধ্যে কোথাও গেঁথে গেছে। প্রায়ই মনে মনে জপ করি - অকারণেই।  কে বা কোথায় এই মন্ত্রোচ্চারণ করেছিল আর আমি প্রথম কোথায় শুনেছিলাম মনে নেই।  মন্দিরে ঠাকুরমশাইকে এই মন্ত্রটা বলতে শুনেছি কিন্তু আমার স্মৃতিতে এই মন্ত্র তারও অনেক অনেক আগে থেকে গাঁথা।  

নামে জপের এক আলাদাই মাহাত্ম্য আছে। 

ছোটবেলায় মনে আছে আমাদের বাড়িতে খবরের কাগজ দিত বুড়ো এক বিহারী।  তার আসল নাম কেউ জানতো না।  সবাই তাকে রাম রাম বলে ডাকতো কারণ ও সব সময়ই রাম নাম জপত।  হাঁসি হাঁসি মুখ।  মাথা সর্বক্ষণ নোয়ানো।  যাই বলো না কেন তার শুধু একই জবাব "রাম রাম ". অদ্ভুৎ না ?  

খবর কাগজটা গোল করে মুড়ে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে ছুঁড়েই জোরে বলতো রাম রাম।  যেন রাম নামের গুনেই খবর কাগজটা ঠিক জায়গায় পৌঁছে যাবে ।  তা একতলা হোক, দোতলা হোক কি তিনতলা হোক।  সবই রাম নামের উপরেই যেন নির্ভরশীল।  

টাকা পয়সার প্রতি তার কোনো মায়া ছিল না।  দিলে ভালো না দিলেও চলে।  তার কাজ শুধু খবর কাগজ বিলি করা। এও এক ধরণের তপস্যা ।  এখন সেটা বুঝতে পারি।  কর্মণ্যে বাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।  ফলের ইচ্ছা না করে শুধু নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সঙ্গে কাজ করে যাওয়া।  

প্রশ্ন হচ্ছে এই চল্লিশ বছরের কর্ম জীবনে কী সত্যিই এই দীক্ষায় আমি দীক্ষিত হতে পেরেছি ? মিথ্যা বলব না।  একেবারেই নয়।  কোনো না কোনো সময় মনের কোনো এক কোনে  হয়তো  অযথা দুঃখ জমেছে।  মনে হয়েছে কিছুই তো হলো না।  কিছুই তো পেলাম না। 




একবার রাম রাম  এই নামের মাহাত্ম্য বুঝিয়ে বলেছিল গ্রামে এক ঝড়ের রাতে কোন এক বট গাছের তলায় সে আশ্রয় নিয়েছিল। সে কি তুমুল বৃষ্টি আর পাগলা হাওয়ার দাপট! চারিদিকে শুধু ফাঁকা মাঠ। আর ঝর ঝর বর্ষণ।   কী মনে করে হঠাৎ রাম রাম সেই অঝোর বর্ষণেই গাছের  ছায়া থেকে বেরিয়ে রাম রাম নাম নিতে নিতে বাড়ির দিকে রওনা হয়।  কতক্ষনই বা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রাত কাটানো যায়।  বৃষ্টি থামার তো নাম নেই। 

কিন্তু  কী আশ্চর্য ! গাছের ছায়া পেরিয়ে কিছু দূর হাঁটা দেওয়ার পরই  কড়  কড়  কড়াৎ শব্দে বজ্রপাত আর পড়বি তো পড় সেই গাছটারই উপর যেই গাছের নিচে রাম রাম আশ্রয় নিয়েছিল। পিছন পানে তাকিয়ে রাম রাম শুধু নাম জপ করেছিল হৃদয়ের অন্তঃকরণ থেকে বিশ্বাসের বল সংগৃহীত করে। 

ঘটনাটা কাকতালীয় বলে উড়িয়েও দেওয়া যায়।  আবার বিশ্বাসে  মিলায়ে বস্তু  তর্কে বহুদূর ! অনেক কিছু আমাদের বুদ্ধি বা বিবেচনার বাইরে।  

রাম রামের ছেলেটিও ছিল একেবারে রাম রামের মতন. নম্র, ভদ্র , সভ্য আর রাম নামে বিলীন।  এরকম লোক এখন আর পাওয়া যায় না। 

স্বামী  সর্বপ্রিয়ানন্দজীর  অদ্বৈতবাদের উপর  চর্চা ইউ টিউবে শুনতে শুনতে  ভাবছি ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস বলেছেন যত মত  তত  পথ। এও  এক পথ  ইশ্বরকে লাভ করার। ভক্তিতে  আপ্লুত হয়ে ডাকা ।  উনি নিশ্চয় সাড়া দেবেন। দ্যাখা দেবেন। কোনো না কোনো রূপে।  কোনো না কোনো ভাবে। আমাদের শুধু একমনে ডেকে যাওয়াই ধর্ম।  ইষ্ট মন্ত্র। 

Friday, March 10, 2023

ট্যারো





এই ছোটো গল্পটি স্টোরি মিরর ডট কমে ও  পাঠক পাঠিকারা পড়তে পারেন 


রিটায়ার করার আগে থেকেই মাথায় অনেক রকম খেয়াল পাকনা মেরে উড়ছিল।  খেয়াল মানে যাকে ইংরেজিতে বলে ফ্যান্সিফুল থটস।  কী করে সময় কাটানো যায়।  অফিসের কলিগ ও বন্ধুরা নানান আইডিয়া চাপালো -

"তোর তো লেখার খুব শখ।  বই-টই   ছাপিয়ে ফ্যাল " - যেন কত সোজা। 

"আমাদের দেশে কত কিছু আছে দ্যাখার - ঘুরতে যা " - মাগো! আমি চিরকালের ঘরকুনো আমাকে ঘুরতে যেতে বলে ?

"বই পড় " - পড়ি ..আর কত পড়বো !

"কিছু শেখ " - যেমন ?

"কোনো এন  জি ও  জয়েন কর" - ঠিকানা দে .. চুপ। 


শেষমেষ  ট্যারোতে আটকালাম।  বাবাকে জ্যোতিষ শাস্ত্র  চর্চা করতে দেখেছি।  আমাদের বাড়িতে  এস্ট্রোলজিক্যাল ম্যাগাজিন প্রতি মাসে আসত । বাবা  পড়তেন।  সেকালের জ্যোতিষী মানে একখানা চটি বই যার মধ্যে লগারিদমের  মতন কী সব ছাই ভস্ম নাম্বারের মতন লেখা তা  দেখে পাতার পর পাতা অংক  কষা -  অক্ষাংশ .. দ্রাঘিমাংশ ..জন্ম তারিখ ..ক্ষণ.. জন্মকালে গ্রহের অবস্থান .. জন্ম স্থান.. আরও কত কি ।  তারপর গম্ভীর মুখে কোন গ্রহ কোথায় বর্তমানে অবস্থিত তা নিয়ে বুঝিয়েদের সঙ্গে আলোচনা করা। যার ঠিকুজি তাকে বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করতে হতো ভবিষ্যৎ জানার জন্য।  

আমার অংকেতে মাথা নেই. কিন্তু জ্যোতিষীতে ইন্টারেস্ট আছে. তাই ট্যারো বেছে নিলাম।  তাস  দেখে ভুত-ভবিষ্যৎ বিচার করা।  সোজা। ট্যারোর মজা হলো যে যার ভবিষ্যৎ বিচার হবে সে  একটি তাস আটাত্তরটি  তাসের বান্ডিল থেকে বেছে নিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই বুঝে নেবে।  আমাকে শুধু তাসের মানেটা তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। 

অনেক বই ঘাটাঘাটি করলাম।  ইউ টিউব দেখলাম। তাস গুলোর ইতিহাস পড়লাম   কেমন ভাবে তাদের সাজাতে হয় ইত্যাদি।  বলা হয়নি - আমি কখনই ব্যাপারটা প্রচার করিনি।  এটা শুধুই হবি।  পয়সা রোজগারের ধান্দা  নয়।  

তবুও জানিনা কী করে জানাজানি হয়ে গেলো।  

টের পেলাম  সকাল এগারোটা নাগাদ পাড়ার এক অবাঙালী  ভদ্রলোক যেদিন এসে হাজির হলেন।

"আপনি ভবিষ্যৎ বলেন?"

"কই না তো ?"

"এই যে  অ বাবু বললেন ?"

আমি ফাঁপরে পড়লাম। 

অ বাবু আমার বাবার বয়সী এবং অতি ঘনিষ্ঠ ভাবে পরিচিত।  তাঁকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ  করা আমার পক্ষে অপরাধ জনক।  তাই  বললাম ,

"ওই একটু আধটু আর কি - তাস দেখে ... হবি এই মাত্র। "

"তাস দেখে ?"

ভদ্রলোকের চোখে মুখে অবিশ্বাস্যের পোলোর 

"হ্যাঁ - ট্যারো ?"

"কী  রো ?"

"যাকগে ... আপনার কী কোনো সমস্যা আছে ?"

"তা আছে বৈকি।  কিন্তু আমি সেটা বলবো না।  সেটা আপনি আমাকে বলবেন। "

বুঝলাম ভদ্রলোক আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন। 

আমি তাসের বান্ডিলটি বার করে সাজালাম এবং তার মধ্যে একটা যে কোনো তাস ওনাকে বেছে  নিতে বললাম। 

উনি একটি তাস বেছে আমাকে দেখাতে আমি একটি লম্বা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম , "আপকে জান কো  খতরা  হ্যায়। "

"ক্যা হ্যায় ?"

আমি রিপীট করলাম , "খ ত রা "

ভদ্রলোক আমার কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাঁসি হেঁসে বললেন, "ও সব বুঝিনা।  আমার এই পাড়ায় একটি ফ্ল্যাট আছে যেটা একটি পরিবার অকুপাই করে রেখেছে।  কিছুতেই খালি করছে না।  আমায় উপায় বাতাও ফ্ল্যাট খালি করার।" 

বড় মুশকিলে পড়লাম।  আমার বিদ্যা অতদূর অবধি নয় যে আমি উপায় বাতলাতে পারি।  তবুও অনেক মাথা চুলকে  উত্তর দিলাম যে পরিবারটির বড়  যিনি তাঁর  সঙ্গে বসে আলোচনা করে দেখুন।  ভদ্রলোকের আমার সমাধান মোটেই পছন্দসই  হলো না।  একটা শ্লেষযুক্ত হু: বলে উনি উঠে বেরিয়ে চলে গেলেন।

এর কিছুদিন পর সকালে কলিং বেল বেজে উঠলো। 

দরজা খুলে দেখি একটি নিরীহ গোছের লোক খুবই বিমর্ষ মুখে দাড়াঁনো। 

জিজ্ঞাসা করাতে জানালেন যে তিনি অমুক নম্বর ফ্ল্যাটের বাসিন্দা।  ওনার বাড়িওয়ালা ফ্ল্যাট খালি করার জন্য ওনাকে উত্ত্যক্ত করে মারছেন। উনি অনেক বুঝিয়েছেন যে ওনার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে।  বিয়ে হয়ে গেলেই ফ্ল্যাট খালি করে গ্রামে ফিরে  যাবেন। ভদ্রলোক রিটায়ার্ড।  একটিমাত্র মেয়ে।  এখন বিয়ের এতো খরচের মাঝে যদি বাড়ি খুঁজতে হয় তাহলে তো উনি বড় বিপদে পড়বেন। বাড়ি বদলানো মানেই ভাড়া বাড়া।  শিরে সংক্রান্তি।  তাই উনি বাড়িওয়ালাকে অনেক অনুনয় বিনয় করেছেন বাড়ি ছাড়ার জন্য এখন ওনাকে প্রেশার না দিতে। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা।  রোজই  এসে হাজির হচ্ছে। ধমকাচ্ছে।  গালি গালাজ করছে। উনি অনন্যোপায় হয়ে আমার কাছে এসেছেন। ওঁকেও অ বাবুই নাকি  আমার কথা বলেছে।  

মনে মনে অ বাবুর উপর রাগ ধরলেও কিছু না বলে ওনাকে ঘরে এনে বসালাম।তাসের বান্ডিল সাজিয়ে একটি তাস বেছে আমাকে দেখাতে বললাম।  উনি তাই করলেন। গোবেচারা মানুষটির উপর মায়া হচ্ছিল।  মিডল ক্লাস  অর্থাৎ মধ্যবর্তী  বর্গ  সব সময়ই অশান্তিতে  ভোগে।  ভদ্রলোকের উসকো খুসকো  চুল মাথার মাঝখানের টাকটিকে ঢাকার ব্যার্থ চেষ্টা করে হেরে গেছে।  লোকটির মুখায়ব ফ্যাকাসে।  এনেমিক মনে হলো।  আহা! না খেয়ে বা আধ পেটা খেয়ে  হয়তো মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা জমিয়েছেন সারা জীবন ভর।  তার উপর বাড়িওয়ালার উৎপীরণ।  

তাসটি বার করে উনি আমার হাতে দিতে আমি মনোযোগ সহকারে অনেকক্ষণ সেটিকে নিরীক্ষণ পরীক্ষণ করে বললাম, 

"চিন্তা করবেন না।  আপনি যেখানে আছেন সেখানেই থাকবেন যত দিন আপানার মন চায়।"

আমার কথা শুনে ভদ্রলোক যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। আমায় হৃদয়ের অন্তঃকরণ থেকে ধন্যবাদ জানালেন। মনে হলো আমার কথা শুনে ওনার হলদেটে চেহারায় লালচে রং খেলে গেলো। নাকি আমারি চোখের ভুল। 

এর কিছুদিন পর  আমার কাজের মেয়েটি এসে জানালো পাড়ায় আজ নাকি দারুন গোল বেঁধেছিল ।  অমুক নম্বর ফ্ল্যাটের  ভাড়াটে তার বাড়িওয়ালাকে বেদম প্রহার করেছে। আমি জিজ্ঞসালাম, "কেন ?" 

জোনাকি রসিয়ে রসিয়ে জানালো বাড়িওয়ালা কয়েক জন গুন্ডা সঙ্গে করে এনে ভাড়াটে ভদ্রলোকের বাড়িতে হানা দিয়ে তাঁর জিনিসপত্র রাস্তায় ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো। ভাড়াটে ভদ্রলোকের কোনো কথাই তারা শুনতে রাজি ছিল না।  এরমধ্যে একজন গুন্ডা নাকি তাঁর মেয়ের হাত ধরে ঘর থেকে টেনে বার করার চেষ্টা করাতে ভদ্রলোক মরিয়া হয়ে হাতের কাছে যা পান তা দিয়ে লোকটিকে  আঘাত  করেন। লোকটা গুন্ডা হলেও পাল্টা মার বোধহয় আশা  করেনি। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়।  তাই দেখে ভাড়াটে ভদ্রলোকের সাহস আরেকটু বেড়ে যায় এবং তারপর উনিও লেগে যান মারামারি করতে। শেষমেষ পাড়ার লোকেরা মধ্যস্থতা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু ততক্ষনে ভাড়াটে ভদ্রলোকটি বাড়িওয়ালার মাথায় জোরে একটা পাথর মেরে ফাটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন । রক্তারক্তি কারবার।  পুলিশ আসার উপক্রম হয়েছিল কিন্তু তার আগেই বাড়িওয়ালা ভাড়াটের  কাছে হাত জোর করে মাপ চেয়ে তাকে বাড়িতে যতদিন ইচ্ছে থাকার অনুমতি দিয়ে দেন।  জোনাকির পাবলিক রিলেশান ভালো। পাড়ার সব রকম কেচ্ছা কেলেঙ্কারির গল্প চাটনি সহযোগে আমার কাছে পৌঁছে যায়। 


এর দু তিন দিন পর 

অ বাবু হন্তদন্ত হয়ে হাজির ,

"শুনলাম নাকি তোমার কাছে অমূক  আর অমূক  বাবু দুজনেই এসেছিলেন ভাগ্য গণনার জন্য"।

মনে মনে বললাম আপনার দৌলতে। 

"আর তুমি নাকি দুজনেরই একেবারে সঠিক  বিচার করেছ ".

আমি আমতা আমতা করে "ওই আর কি "... বলাতে অমুক বাবু বললেন ,

"আঃ ! আর ভণিতা করতে হবে না।  তুমি তো বাড়িওয়ালাকে বলেইছিলে ওঁর প্রাণ নিয়ে টানাটানি আছে আর ভাড়াটেকে বলেছিলে ও যেখানে আছে সেখানেই থাকবে।  তাইতো ?"

আমি মাথা চুলকে বললাম , " ওই নিরীহ, শান্তিপ্রিয় মানুষটিকে দেখে বড়ো মায়া লাগছিলো  তাই আর কি সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য ওই কথাটা বলেছিলাম।  সেটা যে অক্ষরে  অক্ষরে  মিলে  যাবে তা কী  করে  জানবো"?

"সে যাই হোক।  এখন একটা সাইন বোর্ডের ব্যবস্থা করতে হবে।  তোমার পসার এক্কেবারে কনফার্মড"। "

আমি কিছু বলার আগেই অ বাবু সোৎসাহে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। উনি বয়োঃজ্যেষ্ট এবং আমার সেলফ প্রোক্লেমড  গার্জিয়ান। ওনাকে না করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।  তবুও ..

বলা হয়নি এই ট্যারো কার্ডের বান্ডিলটি ওঁর মেয়ে সুমিতারই দেওয়া।  শখ করে কিনেছিল কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই শখ ঘুঁচে গিয়ে আমাকে দিয়ে বলেছিল , "দিদি এ আমার দ্বারা হবে না।  তোমার ইন্টারেস্ট আছে ; তুমি নিয়ে দ্যাখো "। 

এখন ভাবছি ওঁকে বান্ডিলটা ফেরত দিয়ে দেবা। 

সাইনবোর্ড লাগার আগে। 

এই ট্যারো ফ্যারো আমাকে ও পোষাবে না।