Sunday, August 31, 2014

বন্ধ্যা


পাঁচ-ছ বছর আগে আমার মালী রামখেলাওয়ন চারাটা পুঁতে বলেছিল, “দিদি দেখবেন, এক বছরের মধ্যেই চর-চর করে বেড়ে গাছটা ফুলে-ফুলে ভরে যাবে। গন্ধে বাতাস মো-মো করবে”। আশায়-আশায় পাঁচ বছরের বেশী হয়ে গেল। চারাটা বেড়েছে বটে, পাতার বোঝায়  নুয়েও পড়েছে। রবি, তার বাবার লাগানো গাছটাকে বারবার ছেঁটেছে আর আশ্বাস দিয়েছে ফুল আসবে, সুগন্ধে মাতিয়ে দেবে বাগান। আমিও অপেক্ষায় দিন গুনি। কিন্তু দুদিন আগে আগাছার  মত বেড়ে ওঠা পাতার গোছা কাটতে-কাটতে রবি গজ-গজ করে আপন মনে, “ এ দেশী, বুনো গাছ । বাবা কী ভেবে যে লাগালো। এতে ফুল আসা মুশকিল”।

 

না, কিন্তু ফুল এসেছিল। ফিকে, হলদে রঙের। কেমন যেন শুকনো, শুকনো আর গন্ধ ও তেমন নয়। তবে বৎসরান্তে ফুলহীন ডালির আফসোসের চেয়ে মুরছানো ফুলের গুচ্ছর আনন্দ বা কম কীসের ? তাই দুদিনের সেই অতিথিকেও হাঁসি মুখে অভ্যর্থনা জানাই।

 

রবি এ যুগের ছেলে। অধৈর্য স্বরে বলে, “ এ গাছ উপড়ে নতুন লাগাবো। বিদেশী ... একটু দাম বটে। আহা ! তবে তাতে কী গোছা-গোছা ফুল ধরে । আর কী গন্ধ। প্রাণ ভরে যায়”।

 

মনে পড়ে সোনা বৌদির কথা। আমাদের পাশের বাড়ীতে থাকতেন। কেমন যেন লতায়-পাতায় আত্মীয়তা ছিল আমাদের পরিবারের সঙ্গে। বৌদি সন্তানহীনা। রাঙ্গাদা, সোনা বৌদির স্বামী, শান্তিপ্রিয়, মিতবাক মানুষ। খানিকটা ভালেষহীন ও বটে। সোনা বৌদির শ্বাশুড়ীমা ডাকসাইটে মহিলা। বৌদিকে ছেড়ে কথা বলতে পিছপা হতেন না। কারণ একটাই । বৌদি রাঙ্গাদাকে বাবা ব’লে ডাকার একটি ছোট্ট মাণিক উপহার দিতে অপারগ। বংশের কুল-প্রদীপ না  থাকা মানে বংশ লোপ পাওয়া এবং এর জন্য বৌদিই যে দায়ী এই কথাটা সোনা বৌদিকে অহর্নিশি মনে করিয়ে দিতেন বাড়ির বড়রা আর বিশেষ করে রাঙ্গাদার মা। বৌদির সঙ্গে রাঙ্গাদার সম্পর্কেও কোথায় যেন এ নিয়ে চির বেঁধেছিল যদিও ওঁদের মধ্যে এ নিয়ে  কোনও বাদবিবাদ বা মোনমালিন্যের ঘটনা আমরা শুনিনি বা দেখিনি। সবটাই ছিল একটা নিরব অভিমান আর ক্ষোভের আড়ালে । কিন্তু এই নিরবতাই গভীরে আঘাত হানে মানুষের মনে ও জীবনে। মাঝে বেশ কিছুবার প্রিমেচিওর এ্যাবর্শনের দুর্ঘটনা বৌদির বৈবাহিক জীবন দুরুহ করে ও তুলেছে।

 

বিবাহের পনেরো বছর বাদে বৌদি হন শেষ সন্তান সম্ভবা। কিন্তু ডাক্তার মিত্র, বৌদির গাইনি, এই প্রেগ্নেনসির পক্ষে ছিলেন না। বাচ্চা অথবা মা, দুজনের মধ্যে এক জন কে বেছে নিতে বললেন রাঙ্গাদাকে। রাঙ্গাদাকে নিশ্চুপ দেখে বৌদিই জেদ করলেন। তাঁর বাচ্চা চাইই। বাকীটা ভবিতব্য। অনিকে জন্ম দেওয়ার কিছু ঘন্টার মধ্যেই বৌদি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। অনেকটা জেনেশুনে প্রাণের মায়া না করে স্বামীকে দিয়ে গেলেন তাঁর শেষ উপহার। মারা যাওয়ার কিছু মাস আগে বৌদিকে একবার বলতে শুনেছিলাম, “স্বামী হারানোর চাইতে প্রাণ হারানো অনেক সোয়াস্তির রে ভাই!”

 

আজ এত বছর পরে রবির কথা শুনে আমি বাধা দিই। না, থাক গাছটা যেমনটি আছে তেমন এক কোনে। কী বা যায় আসে ? আর হয়তো এমন ও তো হতে পারে ফুলে-ফুলে ভরে উঠবে ওই শুকনো ডালগুলি কোনো একদিন।   

 

সেই দিনের অপেক্ষায় থাকি। আর ঢালি খাদ আর জল নিয়মিত। ফুল দিতে গিয়ে প্রাণ না হারায় সাধের গাছটা আমার।  ঠীক     আমাদের সোনা বৌদির মতন…!!!!