ভেবেছিলাম লিখবো না।
কী হবে লিখে নীলরতন বাবুর গল্প ?
একজন ছাপোষা মানুষের আবার গল্প কী ?
কিন্তু উনি যে এতো তাড়াতাড়ি একজন প্রখন বিশ্লেষণকারী, ব্যতিক্রমী গোয়েন্দা হয়ে দাঁড়াবেন তা কে জানতো ?
রিটায়ার্ড লোক তবুও রুটিন মাফিক চলার অভ্যাস।
হ্যাঁ , আমি সেই নীলরতন বাবুর কথাই বলছি।
সকাল ছটা থেকে তাঁর দিন শুরু ..
এক কাপ চা ...
তারপর নিত্যকর্ম ...
আধ ঘন্টা খবর কাগজ নিয়ে নাড়াচাড়া ...
একবার পাড়ায় ঢু মারা ..
ফিরে এসে মাসিমার হাতের তৈরি জলখাবার ...
একটু জিরোনো ...
তারপর ডায়েরী লেখা ... কী লেখেন তা কেউ জানেনা - নট ইভেন মাসিমা।
তারপর দুপুরের ভোজন .. ..
নাক ডাকিয়ে ঘুমোনো মাস্ট - আড়াই ঘন্টা খানেক ..
বিকেলে পার্কে ঘোড়া এক ঘন্টা ...
যত পাড়ার রিটায়ার্ড জ্যাঠাদের আড্ডায় কুড়ি মিনিট মতো বসা ...
বাড়ী ফিরে টিভির নিউজ ...
কিছুক্ষন গল্পের বই বা অন্য কোনো পত্রিকা পড়া ...
নটার মধ্যে ডিনার ...
শেষে আবার নাসিকা গর্জন ...
এহেন আনইন্টারেস্টিং দৈনন্দিন জীবনে হঠাৎ ঝড় বয়ে গেলো।
নীলরতন বাবুর পিসিমণি দুগ্গাপুর থেকে আমের আচারের একটা বিশাল বোয়েম পাঠিয়েছিলেন।
নীলরতন বাবুর আবার আচারের ভিষণ শখ।
তবে পিসিমণি বলে দিয়েছিলেন যে একটু আধটু বোয়েমে রোদ লাগানোর দরকার।
মাসিমা তাই রোজ ছাতে বোয়েমটা সকাল বেলা রেখে দিতেন অরে ঠিক দুপুর তিনটে নাগাদ বাড়ীর পুরোনো ঝি পদ্ম ওটাকে তুলে রাখতো।
গোল বাঁধলো এক সপ্তাহ বাদে যখন পদ্ম ছাতে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে-কাঁদতে নিচে এসে জানালে যে বোয়েম উধাও।
এতো বড় বোয়েমটা কে নেবে ? কার এতো আচার খাওয়ার শখ.. আর যদি শখই হয়ে থাকে তাহলে বললেই তো হতো। একটা ছোট শিশি ভোরে দিয়ে দেওয়া যেত...
পাড়ায় খবর ছড়াতে দেরি লাগলো না। .
নীলরতন বাবু তড়িঘড়ি করে পাড়ায় বেরিয়ে গেলেন। হাতে ডায়েরী।
ফিরে এসে ঘন্টা দেড়েক ডায়েরীতে কী সব লিখলেন।
আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে বোয়েম ফেরৎ।
অবাক কান্ড
কে নিয়েছিল সেটা বড় কথা নয়....
কী করে পাওয়া গেলো এবং নীলরতন বাবু সেটা কী করে এত শীঘ্র ধরে ফেললেন সেটা শুনে সব্বাই তাজ্জব ..
যেদিন বোয়েম নীলরতন বাবুর বাড়ীতে ডেলিভার হয়েছে সেদিন থেকে কার কার সঙ্গে কী কী বিষয়ে কোন কোন সময় কত ঘন্টা ক মিনিট এবং ক সেকেন্ড কথা হয়েছে তার পুরো বিবরণ নীলরতন বাবুর ডায়েরীতে লিপিবদ্ধ।
যার যার সঙ্গে আচারের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে সেগুলো আন্ডারলাইন করা আছে উইথ টাইম।
এর পর টাইম এনালিসিস করা হয়েছে। কিনি কত বেশি বা কত কম সময় এই বিষয় নিয়ে কী কী কথা বা তর্ক বিতর্ক করেছেন। যে কম করেছে তাঁর মনের কোনো আঁধার কোনে আচারের প্রতি আসক্তি লুক্কায়িত রয়েছে কিনা। সেটার সাইন্টিফিক ডিডাকশন করা হয়েছে। যে বেশি বলেছে তাঁর তো কথাই নেই.. এরপর এ বি সি এনালিসিস। .. হিউমান সাইকোলজি আরও কত কী......
মোদ্দা কথা এহেন চুলচেঁড়া বিশ্লেষণের পর বোয়েম যে পাওয়া যাবে না এই বিষয়ে আর কোনো সন্দেহই থাকে না...
নিন্দুকেরাও নীলরতন বাবুর এই ডিটেল্ড ইনভেস্টিগেশনের তারিফ না করে থাকতে পারলেন না।
এর কিছুদিন পর ...
পদ্ম আবার ছাত থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে নিচে নেমে এসে হাঁক ছাড়ল , "অ বৌদি ! দাদা বাবুর যে আদ্দিকালের হলুদ রঙের কালো পাড় লুঙ্গি যার পিছনে দুটো ফুটা ..সেটা আবার কে কাপড় মেলার তার থিকা উঠায়ে নিসে"।
নীলরতন মাসিমা মাত্র পানের বাটাটা নিয়ে শোবার ঘরে ঠান্ডা মেঝেতে বসেছিলেন। পদ্মর কথা শুনে, "শুনলে গা .." বলে বসবার ঘরের দিকে ঘাড়টি ঘোরালেন।
আর মাসিমার বলার সঙ্গে সঙ্গে নীলরতন বাবু তক্তপোষ থেকে তড়াক করে লাফ মেরে টেবিলের উপরে রাখা ডায়েরীটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
পদ্ম ঘরে মাত্র পা দিয়েছিলো। দাদাবাবুর তড়িৎ গতি দেখে সে কাঁধ ঝাকিয়ে " যাক আর চিন্তা নাই..তাড়াতাড়ি খোয়া জিনিস পাওয়া যাইব .." বলে হাঁপ ছাড়লো। ..
এরপর এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
নীলরতন বাবুর বাড়ির সামনে প্রায়:সই লম্বা লাইন দেখা দিতে লাগলো। কলিং বেল ঘন ঘন বাজতে শোনা যেতে লাগলো।
কারো মেনি
কারো দুধের প্যাকেট
কারো কাঁথা স্টিচের পাঞ্জাবির খুলে পড়ে যাওয়া বোতাম
কারো ডাল বাটা
মায় পাশের বাড়ীর ন্যাকা বৌদির শাড়ির সেফটি পিন
কারো কিছু ...আর কারো কিছু ... হোয়াটেভার
খোয়া গেলেই নীলরতন বাবু ডায়েরী সমেত ব্যাস্ত হতে দেখা যেতে লাগলেন ।
ক্রমশ: নীলরতন বাবুর প্রখ্যাতি পাড়া ছাড়িয়ে দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।
একবার তো মশাই কোন ধ্যাধ্যারা গোবিন্দপুর থেকে এক মালদার আসামি এসে হাজির।
বললেন, " আমি কৈবল্যদায়িনীপুর থেকে আসছি মশাইয়ের নাম ডাক শুনে... "
ভদ্রলোকের বিশাল আমের বাগান থেকে কে বা কারা আম চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে - সে একটা দুটো আম নয়,ভাই, কিলো-কিলো ..
নীলরতন বাবুকে তিনি অনুরোধ করলেন ওনার সঙ্গে কৈবল্যদায়িনীপুর যাওয়ার জন্য।
কিন্তু যেতে আর হলো না ... নীলরতন বাবু নিজের বসার ঘরের তক্তপোষে বসেই ভদ্রলোককে চার ঘন্টা ধরে প্রশ্ন করে চোরটি কে এবং তাকে কী ভাবে ধরা যেতে পারে বলে দিলেন। দুদিন পর এক ঝুড়ি সোনালি রঙের আম বাড়ীর দোর গোড়ায় পৌঁছে যেতেই পাড়া শুদ্ধু লোক কনফার্মড হলো যে নীলরতন বাবুর বিশ্লেষণ একেবারে অন ডট লেগেছে।
মোট কথা হলো নীলরতন বাবুর একঘেঁয়ে রিটায়ার্ড লাইফ দিন কে দিন উত্তেজনাময় হয়ে উঠছে এবং সাধারণ মানুষের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিস যা হারালে জীবন উথাল - পাথাল হয়ে যায় এবং থানা-পুলিশ, কোর্ট কাছারি করেও কিছুই কাজে আসে না সেখানে নীলরতন বাবুর বিনা পারিশ্রমিকে টাইম থিওরি , এ বি সি এনালিসিস আর হিউমান সাইকোলজি আর দেয়ার।
জয় হউক।