Friday, December 28, 2012

ভৌতিক (ভুমিকা)


গরমের ছুটি পড়ে গেছে। স্কুল বন্ধ। মনে আনন্দ তো আছেই কিন্তু তাঁর সঙ্গে এক রকমের  উত্তেজনা ও রয়েছে বইকি । কী করব ? দু মাসের লম্বা ছুটি – কী-কী করে কাটাব, কোথায়-কোথায় বেড়াতে যাব, কোন-কোন বন্ধুর সঙ্গে জটলা বেঁধে আড্ডা মারব, তাঁর একটা লিস্টি বানাব-বানাব ভাবছি এমন সময় দিদির হঠাৎ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আর গলা ব্যথা শুরু হল। দেখতে-দেখতে  দু  গালের  নিচের দিকে কান দুটো ঘেষে গলার কিছু অংশ ফুনকো লুচির মতন ফুলে ঢোল হয়ে গেল !আমি হেঁসে ভেংচি কাটি , "গাল ফোলা  গোবিন্দের মা "!!!  
 মা মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “গেল যা,  সব প্ল্যান ভেস্তে”।

“কী প্ল্যান”? আমি উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞাসা করি।

“কলকাতা যাবার”। মা জানান।

“কবে হল এই প্ল্যান”? আমি শুকনো মুখে শুধোই।

“এই কিছু দিন আগে। ভেবেছিলাম তোকে সার্প্রাইজ দেব। তা আর হল না। তোর দিদি আবার মাম্পস্ বাঁধিয়ে বসল। এখন থাক বন্দি হয়ে ঘরের মধ্যে এক মাস”।

মার রাগ হওয়া স্বাভাবিক। সতেরো বছর পরে কলকাতা যাওয়ার প্ল্যানটা এমনি ভাবে মাটি হয়ে যাবে ভাবা যায়নি।  

বাবু বললেন “আরে! শেলীর ওপরে রাগ করে কী হবে? ও কী ইচ্ছে করে রোগ বাঁধিয়েছে? এ তো ভীষণ ছোঁয়াচে। হাওয়ায় জীবাণূ ভাসছে। কখন কাকে আক্রমণ করবে কোনো খবর আছে”।

ব্যানার্জী কাকু, বাবুর বন্ধু, মাকে আরো ভাবিয়ে তুললেন, “ বৌদি, সাবধান! শেলীর যখন হয়েছে তখন মিঠুর হতে বাধ্য। আপনি বরঞ্চ মিঠুকে কলকাতা  পাঠিয়ে দিন। এখানে এক ঘরে শোওয়া-বসা, পড়া-খেলা। নো! নো! ভীষণ রিস্ক, বুঝলেন, জহর দা”।

বাবা বলেন, “তাই তো। কথাটা মন্দ বলেননি, ব্যানার্জী বাবু”।

আমি আঁতকে উঠি, “একা! কলকাতা” ?

মা ও ইতস্তত করেন, “ ওকে না হয় অন্য ঘরে রাখব...”

কথা না শেষ হতেই, ব্যানার্জী কাকু হাঁ-হাঁ করে ওঠেন, “ এক ঘর, এক বাড়ি, সব সমান। দু জনেই বিছানা নিলে আপনি কী করে একা দুটি পেশেন্ট সামলাবেন, বলুন তো”?

কথাটা যুক্তিযুক্ত মনে হলেও মা বললেন, “ কার সঙ্গে যাবে ও ? একলা আমি মোটেও ছাড়ছি না”।

“একা কেন? আমি তো আছি”। ব্যানার্জী কাকু আশ্বাস দেন।

প্রতি বছরের মতন এই বছর ও কাকু দু-তিন মাসের জন্য কলকাতা পাড়ি দিচ্ছেন, জানালেন এবং ওনার বোরিং, একক যাত্রা ইন্টারেস্টিং করতে এবার সঙ্গে থাকব আমি। হাওড়ায় ছোটকা আমায় রিসিভ করে নেবেন – সমস্যার সমাধান মুহূর্তের মধ্যে করে ফেললেন ব্যানার্জী কাকু।

আমি অবশ্য মাঝে নাকি সুর ধরেছিলাম, “ মা, আমি কলকাতায় কাউকে চিনিনা...”

মা মাঝ পথেই থামিয়ে দিলেন, “ চিনি না মানে ? কাকু, পিসী, পিসেমশাই, মাসি-মেসো, দিদি-দাদারা, সবাই তো আছেন। গেলেই ভালো লাগবে, দেখবি”।

কথা হচ্ছিল বৈঠকখানা ঘরে বসে। পাশেই আমাদের শোবার ঘর। এখন অবশ্য সেই ঘরের দিদিই একচ্ছত্র অধিপতি, থুড়ি, অধিপত্নি। পাশাপাশি ঘরের কথাবার্তা পরিষ্কার শোনা যায়। রাতের খাওয়া শেষে মার ঘরের দিকে যেতে গিয়ে দিদিকে দরজার এদিকে দাঁড়িয়ে গুড নাইট বলতেই  আমাকে দিদি ইশারায় ভিতরে আসতে বলে। আমি বলি, “ঘরে ঢুকতে যে মানা”। “দূর ভীতু, তোর দ্বারা আর কিসস্যু হবে না”। মানে লাগল, এগিয়ে গেলাম, “কী বল”।

দিদি ফিসফিসিয়ে বলে, “ব্যানার্জী কাকু তোকে সঙ্গে নিয়ে কেন যেতে চাইছেন বল তো”?

আমি বলি, “কেন, তোর অসুখ তাই”।

দি বলে, “দূর্ বোকা! অত খানি পথ ! জানিস কত? ১৪৫০ কিলোমিটার,  দিল্লী থেকে হাওড়া... সারা পথ তোকে ওঁর যত রাজ্যের আজগুবি গপ্পো শুনতে হবে,  বলে দিলুম। আর তো কেউ শোনানোর নেই তাই তোকেই গপ্পোগুলো গেলাবেন । খবরদার! বলে দিলুম, একটা ও বিশ্বেস করিস্ নে যেন। তুই তো বোকা। ভাববি বুঝি সবই সত্যি। ”  

ব্যানার্জী কাকুর এই বড় দোষ এবং গুন ও বটে। দারুন রসিয়ে-রসিয়ে গল্প করতে পারেন। যখন গপ্পো ফাঁদেন তখন শুনতে-শুনতে তাক লেগে যায়। তবে পরে অনেকবার মাকে বলতে শুনেছি যে বেশীর ভাগটাই ওনার কল্পনা-জগতের সৄষ্টি – অনেক খানিই অতিরঞ্জিত।  

মাথা নেড়ে তাই বলি, না  সবটা যে সত্যি নয় সেটা মনে রাখার চেষ্টা করব। আমি আবার গল্পের পোকা। সত্যি আর কাল্পনিকের মধ্যে যে একটা সুক্ষ্ম বিভেদ আছে সেটা মাঝে-মাঝে ভুলে যাই।


 

রাত্রে ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখি রাজধানি ট্রেন রাতের অন্ধকারে সাঁ-সাঁ করে রেল লাইনের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে। কম্পার্টমেন্টের মধ্যে আমি আর ব্যানার্জী কাকু শুধু জাগা। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে কিন্তু ব্যানার্জী কাকুর গল্প আর শেষ হচ্ছে না। যত বলি কাকু এবার শুতে যাই, কাকু মাথা নেড়ে বলেন, আরে খুকি আরেকটু শোনো না তারপর কী হ’ল। ওমনি দিদি কোথা থেকে চলে এসে চোখ পাকিয়ে আমায় শাসায়, “ তোকে আগেই বলেছি না, একদম বিশ্বাস করবি না, হাঁদা কোথাকার”। আর আমি সজোরে মাথা নেড়ে বলি, না! না! করিনি, করিনি বিশ্বাস।

মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখি গা ঘেমে নেয়ে এক সা, পাখা বন্ধ, লোড শেডিং...

 


মধ্য রাতের স্বপ্ন কী সত্যি হয়? ব্যানার্জী কাকুর টুন্ডলার জঙ্গলে বাঘের পাশে বসে গরম-গরম জিলিপি খাওয়ার গল্প শুনতে-শুনতে তাই ভাবছিলাম। ঠান্ডা-ঠান্ডা লাগছিল। কাকু টিটিকে বলে এসিটা কমানোর অনুরোধ করলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই কী সন্দেহ হওয়াতে আমার কপালে হাত রেখেই আঁতকে উঠলেন, “ খাইসে! তোমার তো দেখছি গা পুড়ে যাচ্ছে”। গলাটাও খুসখুস করছিল আর ঢোক গিলতে ও কষ্ট হচ্ছিল। কাকুকে বলাতে উনি মাথায় হাথ দিয়ে আফসোস করতে লাগলেন, “ ইস্! যার থেকে বাঁচাবো ভাবলাম, তাই জাপটে ধরল। কথায় আছে না, তুমি যাও বঙ্গে আর তোমার ভাগ্য যায় সঙ্গে। এক্কেবারে মোক্ষম  ফললে, দেখেছ”। আমার তখন আর দেখার অবস্থা ছিল না। হাওড়া পৌঁছে ছোটকার হাথ ধরে কী করে বড় পিসীর বাড়ী এলাম জানা নেই।

যদি হুঁস থাকত তাহলে হয়তো পূর্বেই কিছুটা আন্দাজ করতে পারতাম যে এ বাড়ী যে-সে বাড়ী নয়। এখন রাত পৌনে বারোটা। আর লিখব না। লেখা মানেই পুরোনো স্মৄতি জিইয়ে ওঠা। নিশুতি রাতের নিঃস্তব্ধ আঁধারে সে সব শুপ্ত স্মৄতির ঘুম নাই বা ভাঙ্গালাম।

এখানেই এবার ইতি টানলাম...

বিদায়...

Saturday, December 22, 2012

অনেক দিন পর নিজেকে ফিরে পেলাম


ল্যাপটপটা ক্র্যাশ করে যাওয়াতে জগত থেকে বিচ্যুত, অন-লাইন বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে পারছিলাম না। মন হাকুপাকু করছিল। যাইহোক, ল্যাপটপটা তো ঠীক হতে লাগল প্রায় হপতা খানেক কিন্তু সমস্যা দাঁড়াল মাইক্রোসফ্ট(২০১০) অফিস নিয়ে। আমার আগের ভার্সানটা ছিল ট্রায়াল ভার্সান। হার্ড ডিস্কটা বদলাতে গিয়ে দেখা গেল মাইক্রোসফ্ট আবার ইন্সটল করতে হবে। আমি আবার অত কম্পিয়ুটার সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল নই। আমার কম্পিয়ুটারে সব রকম ডাউনলোড আমার বোনপো করে থাকে। তাঁকে আবার পাওয়া মুশকিল – সে এখন বেঙ্গালোরে।

সব রকম প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে শেষ-মেষ গত সপ্তাহে ল্যাপটপটা চালু অবস্থায় এসেছে। আজ অভ্র কীবোর্ডটা ডাউনলোড করে ফেললাম। এখন সোয়াস্থি।

আজ আমার জন্মদিন।

জন্মদিনে নিজেকে এই উপহার দিলাম – ঘরে ফিরে আসার।

এখন চুটিয়ে গল্প করা যাবে কেমন?

Saturday, October 06, 2012

দ্রাক্ষা ফল টক!


জীবনে বিফলতার আলাদাই দাম আছে। কেউ মানুক ছাই না মানুক, আমি মানি, আমি জানি, এবং এই গুহ্য অনুভূতির খবর সেই রাখে যে জীবনে নিষ্ফলতার স্বাদ ভোগ করেছে। কথাটা ক্লীশেড (clichéd) অর্থাৎ বহু সংখ্যক বার নানা ভাবে বহু প্রাজ্ঞ ব্যাক্তির মুখে শোনা, বহু বিধ মঞ্চ আলোড়িত করে চর্চিত, বহু আড্ডায় তুফান তুলে আলোচিত ও গর্বিত স্বরে ঘোষিত - তাই নয় কি?

তবু ‘আমি বিফল’ এই কথাটা কেউ মুখ ফুটে বলতে চায় না। বিফলতা লজ্জাদায়ক, প্রেরণাদায়ক নয়। কিন্তু আশ্চর্যের ঘটনা এই যে অনেক নামচিন ব্যক্তি নিষ্ফলতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই সফলতার মুখ দেখেছেন। মজার ব্যাপার এই  যে , সফল ব্যাক্তি গর্বের সঙ্গে বলতে পারেন ‘আজ আমি সফল কিন্তু এক কালে এই আমি বিফলতার দহনে দগ্ধ ছিলাম’কিন্তু যে হামেশাই অসফল, তার অসফলতা তার জীবনের মাপকাঠি  হ’য়ে দাঁড়ায়। ‘ও লোকটা জীবনে কিছু করতে পারলে না’, শ্লেষোক্তি; ‘উনি কি ছিলেন আর এখন কোথায় পৌঁছেছেন,’ সম্মানোপযোগী বইকি!

বিফল মানেই পুরুষার্থের অভাব; সফল মানেই অসাধারণ কর্মঠ । সব সময়ই কি তাই? ‘লাক ফেক্টার’ ইংরাজীতে একটা কথা আছে – ভাগ্য সদয় – সব   ব্যাঞ্জনে নুনের মতন অপরিহার্য। এ যুগের যুবক-যুবতী বর্গ একথা মানতে অনিচ্ছুক (তাঁরা ভাগ্যকে নিজের হাতে গড়ে নিতে চায়)। বেশ কথা। বয়স কালে আমি ও মানতাম না । এখন মানি? হয়ত মানি । মেলোড বাই এজ – অর্থাৎ বিগতযৌবনার অনুশোচনৌক্তি। হতে পারে। তবে অনেক সময় দেখেছি পরিশ্রম কাজে দেয়নি, যা চেয়েছি তা পাইনি – উদ্যমের অভাবে নয় নিজেকে ঠীক সেরকম ভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরতে পারিনি তাই। যাকে ইংরাজিতে বলে ‘হাইপ’, মেনেজমেন্টের বুলিতে বলে ‘এক্সপোজার’কর্পোরেট জগতে কর্মীর মেরিট, শ্রম ও অধ্যবসায়ই শেষ কথা নয়। চাকুরীক্ষেত্রে আমি একটি মার্কেটেবল কমোডিটি  আমার মার্কেট ভ্যালু আমার সেলেবিলিটির উপর নিরভর্শীল মোদ্দা কথা হ’ল আমি নিজেকে সেল করতে পারিনি। গোঁড়ায় গলদ। চাকুরী জীবনের শুরুতেই সুমনের সেই বিখ্যাত গানটা শুনে ফেলেছিলাম – ‘ যদি ভাব কিনছ আমায় ভুল ভেবেছ’। এবং তাদ্দ্বারা ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম ।

সে কথা বাদ দিলাম না হয় ।

তাহলে সফলতার পরিমাপ কী ? মাথার ঘাম পায়ে ঠেলে কাজ করে যাওয়া চুপিসারে ? নাঃ, সেটা আমার মতন চিনির বলদের একপেশে ট্রেডমার্ক । এই প্রোফেশনাল তাড়িত যুগে সফলতার চাবিকাঠি একটাই -  কিছুটা কাজ (দেখানো!), কিছুটা প্রোফিশিয়েন্সি আর অনেক খানি এগজিবিশনিজম্। মানে এক আনা কর্ম  নিপুণতা বা দক্ষতা আর ষোলো আনা আড়ম্বর। এই ফর্মুলা/মন্তব্য বিতর্কের ঝড় তুলবে। তুলুক।

আজকালকার ৮০% প্রোফেশনালদের আমি এইরুপ  মনোভাব পোষণ ও উক্তি জ্ঞ্যাপন করতে শুনেছি। সার মর্ম এই যে আমি এরকম প্রোফেশনাল নই, ছিলাম না, হতে পারব না, হওয়ার ইচ্ছা রাখিনা। আমি বিফলকামই সই।

‘কি পাইনি, তার হিসাব মেলাতে মন মোর নহে রাজি’। 

বিফলতা আমায় মজবুত করুক। সুখের চেয়ে শান্তি ভালো। শান্তির চেয়ে ও সোয়াস্তি আর সন্তুষ্টি ভালো। আর তার চেয়ে ও ভালো নিজেকে সব সময়  প্রুভ করার স্ট্রেস থেকে মুক্ত থাকাএটা যদি  ইনকম্পিটেন্ট ও যোগ্যতাহীনের দার্শনিকতা বলে মনে হ’য় – তবে তাই।

---

রাত একটা নাগাদ ব্লগটি লিখে কী খেয়ালে ফেস বুকে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে সবুজ, আমার সাথী-ব্লগারকে অন-লাইন পেলাম। দেড়টা অবধি চ্যাট করে শুতে গিয়ে মনে হল ব্লগটা সততই নিরপেক্ষ হয়নি। সত্যিই কী পরিস্থিতি বিফলতার জন্য দায়ী ? কোথাও কী ডিটার্মিনেশনের অভাব ঘটেনি? কখনো কী শ্রমে মাঝ পথে বিরাম টেনে হাল ছেড়ে দিইনি? তাড়াতাড়ি পরাজয় স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যেও কী পলায়নবাদী মনোভাব দৄষ্ট নয় ? সব প্রশ্নের উত্তর শৎ-প্রতিশৎ  হ্যাঁ না হলে ও আবার একশো ভাগ না ও নয়।

জীবনটা হ্যাঁ-নার পাঁচমিশালী ডাল। ফোঁড়নের অভাবে ফিকে হয়ে গেছে। এক-কালে ভালো রাঁধুনি বলে খ্যাতি ছিল। আজকাল মশলার প্রোপর্শন গুলিয়ে যায়। তাই ফলাহার করেই দিন ব্যয় হয়। রসদের অভাব তাই ভালোমন্দ খাওয়া জোটে না । আর সে জন্যই হয়তো দ্রাক্ষা ফল টক!!    

রান্নায় যেমন ফোঁড়ন আর মশলার মাপ-ঝোঁক খাদ্দ্যের স্বাদ কমায় বাড়ায়, তেমনি জীবনের স্বাদ ও (সফলতা- বিফলতার) আমাদের নিজস্ব ফোঁড়নের আর মাল-মশলার আঁকিঝুকির উপর নির্ভরশীল। কোথাও মশলার অভাব ঘটেছে কিম্বা কোথাও হয়েছে আধিক্য। যেমন পিছনে হটে যাওয়া দেয় পরাজয়ের গ্লানি তেমনি এগিয়ে না আসাও দিয়েছে আরো পিছনে ঠেলে। কোনটা ঠীক বলা মুশকিল – পিছনে হটে যাওয়া না এগিয়ে না আসা। ভেবে দেখতে হবে। সঠীক মুল্যায়ণ বিচার সাপেক্ষ। তবে এটা ঠীক হিসেব শেষ-মেষ হরেদরে সমান। তাই আবার বলি – “জীবন খাতার প্রতি পাতায় যত কর হিসাব- নিকাশ কিছুই রবে না ”।  

আসি...        

Saturday, September 15, 2012

কিছু সত্যি কিছু গল্প


বাড়ীটা চোখে দেখিনি । কিন্তু মনের কোণে একটা ছবি আঁকা আছে - বাগান ঘেরা, বিশাল।  বাঁধানো দালান, বড়-বড় ঘর, বিরাট-বিরাট জানালা আর দরজা, উঁচূ ছাদ লম্বা, টানা দেয়াল ঘেরা। জানালার কপাটগুলোয় রঙ-বেরঙের কাঁচ বসানো যার মধ্যে দিয়ে সোনা রোদের ঝিলিক খেলা করে ঘরের মেঝেতে। মা বলেন বাগানে একটা বড় পুকুর ছিল - বাঁধানো ঘাট, ছায়া ঘেরা। স্বচ্ছ স্ফটিকের  মতন জল। জলে বাগানের সবুজ মিলেমিশে একাকার।


বাগান পেরিয়ে পথ চলে যায় এঁকেবেঁকে প্রবেশ দ্বারের দিকে যাকে আজকাল কার আধুনিক ভাষায় বলে গেট। গেটের বাইরেই রোয়াক। বৈকালে ছেলেদের আড্ডা জমে সেখানে আর গুরুজনেরা বসে তামাক টানেন গুড়-গুড় করে মধ্যাহ্নে। গেটের পাশেই একটা কামিনী গাছ ফুলের ভারে ঝুঁকে পড়েছে রোয়াকের উপর। শ্রান্ত পথিকেরা প্রায়ঃ ই এসে বসত রোয়াকে। কিছুক্ষণ জিরিয়ে আবার পথ চলার উদ্দ্যম ফিরে পেত।


আর এসে বসত সেই মেয়েটি – এক পীঠ এলো চুল, কপালে সিঁদুরের টক্ টকে টিপ, লাল পাড় সাদা সারি। ভারী মায়া জাগানো মুখের শ্রী কিন্তু চোখ দুটি বড়ই উদাসীন।  বাড়ীর পাশেই সিদ্ধেশ্বরী দেবীর মন্দির। মন্দিরের পিছনে নদী বয়ে যায় কুল কুল করে - কী নাম জানি। কতদিন সেই মেয়ে মন্দিরের ঘাটলায় বসে থাকে বিষণ্ণ মনে। নদীর শান্ত প্রবাহে কী যেন  খোঁজে। নতুবা চেয়ে থাকে উদাস চোখে দূর দিগন্ত পাণে যেখানে আকাশ মেশে পৃথিবীর বুকে। সংসারে তাঁর মন বসে না। শ্বাশুড়ীর গঞ্জনা,  প্রতিবেশীদের টিটকারী, আত্মীয় স্বজনের খিটিমিটি সবই সে অগ্রাহ্য করে, কিছুই তাঁর গায়ে লাগে না।


একদিন ভর দুপুরে বাড়ী ফেরার পথে ছায়া-স্নিগ্ধ রোয়াকে এসে বসে সেই মেয়েটি। বাড়ীর কর্তা তখন বাগানেই পায়চারী করছিলেন। অবেলায় ক্লান্ত মেয়েটিকে বাইরে বসে থাকতে দেখে সস্নেহে ডেকে বলেন, “বাইরে কেন মা? ভিতরে এসে ব’স”।  মেয়েটি উত্তর দেয়, “আপনি যখন মা বলে ডেকেছেন, তখন আমি আপনাকে বাবা বলেই সম্বধোন করি”। কর্তা বলেন, “ বেশ তবে তাই হোক। আজ থেকে তুমি আমার আরেক মেয়ে হ’লে। তবে আর বাইরে কেন ভিতরে এস”। মেয়ে বলে, “না বাবা! আমি ভিতরে আসব না। এখানেই বেশ আছি”।


সেই থেকে শুরু এক অভিনব সম্পর্কের। বাড়ীর কর্তা হলেন বাবা আর গিন্নী হলেন মা। তবে মেয়েটিকে কিছুতেই ঘরের ভিতরে আনতে পারেননি কর্তা। শুধু কামিনী গাছটি বাবা-মেয়ের এই অদ্ভুত সম্পর্কের টানকে প্রত্যক্ষ করেছে নীরবে।


শহর ঢাকা। ইংরাজী সন ১৯৪৭ সালের ও কিছু বৎসর আগের কথা।


তারপর কেটে গেছে কত বছর। সেই মেয়েটির হয়েছে জগত জোড়া নামডাক। সবাই মা বলতে অজ্ঞ্যান।কত সেবক-শিষ্য-অনুচর বৃন্দ তাঁর – ডাকসাইটে নেতা, গণ্যমান্য ব্যক্তিগন, সমাজের প্রতিনিধি যাঁরা। কিন্তু এত খ্যাতি-মান সত্ত্বেও ভোলেনি সে সেই ঢাকার দিনগুলি। “মা ঢাকার অমুক বাড়ীর মেয়ে এসেছেন দেখা করতে” বলার সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর খাস অনুচর এসে মায়ের ঘরে  সোজা নিয়ে গিয়েছে অপেক্ষমানাকে। বাইরে এক মুহূর্তও সহস্র দর্শনার্থীদের ভীড়ে লাইন দিয়ে দাঁড়াতে হয়নি।


এসব এখন গল্প মনে হয়। তবে মাঝে-মাঝে বড় ইচ্ছে করে সেই শহর, সেই পল্লী, সেই পথ যদি ফিরে পাওয়া যেত। ছুটে চলে যেতাম ...কিন্তু কোথায়?


আছে কী সেই ঢাকা শহর, সেই বাগান-ঘেরা বাড়ী, সিদ্ধেশ্বরী দেবীর সেই মন্দির আর সেই ফুলের ভারে নুয়ে পড়া কামিনী গাছ?


তবুও কেন জানিনা...


সত্যিই ভিটের টান বড়ই সাংঘাতিক!!   

Thursday, September 06, 2012

ভালবাসি, ভালবাসি!


আমি মনে প্রাণে বাঙ্গালী, তায় আবার ভেতো বাঙ্গালী। অজস্র উদাহরণ দিতে পারি এই অকাট্য সত্যিকে যুক্তিগত ভাবে প্রমাণিত করতে কিন্তু তর্কের ঘোরপ্যাঁচে পড়ে ব্লগের বারোটা বাজাতে চাই না। তাই শুধু বলি “ভালবাসি, ভালবাসি” এই বাংলা ভাষার অমুল্য সম্পদ, সংস্কৃতি ও সৃজনীকে।  

হ্যাঁ! প্রবাসী হয়ে ও বাংলার সাহিত্যিক ঐতিহ্য ভুলিনি। বাংলা গল্পের বই পড়ে বড় হয়েছি এবং ভাষা জ্ঞান ও সাহিত্য প্রেম দুই ই জেগেছে। অতয়েব, বাংলায় ব্লগ লেখার ইচ্ছা, দেরিতে হলে ও, মোটেও হুজুগে ব্যাপার নয়।  প্রযুক্তিগত স্বাচ্ছ্যন্দ ও সুযোগের দরুণ একটা অনেক দিনের অপূর্ণ বাসনা ইলেক্ট্রনিক পর্দায় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মূর্ত হল।


তবে বাংলায় লিখতে গিয়ে দু দশকের ও অধিক সময়ের অনভ্যাস ধরা পড়ে গেল। বাংলা হাথের লেখা কোনোকালেই মুক্তোর মতন ছিল না। এখন তো কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং ও যে কোনো হাথের লেখা প্রতিযোগীতায় আমার অক্ষর-সাধনাকে কাঁচকলা দেখিয়ে মেডেল নিয়ে যায় আর কী!

  
ভাষার দুর্বলতাও কম নয়। যথার্থ শব্দ চয়নে হোঁচট খেয়ে যাই বারবার। অভিব্যক্তি ও সাবেকী। আমার সাথী ব্লগার, সবুজ, আমায় আধুনিক বাংলা পত্র-পত্রিকা পড়ার রায় দিয়েছেন। কথাটা ঠীক! সমকালীন বাংলা চর্চা কী পর্যায়ের তা অবিশ্যি জানা দরকার।  


শতেক সীমাবদ্ধতা সত্তেও বাংলায় লিখছি এটাই আমার বাঙ্গালীয়ানার পরিচয়। আশা রাখি লিখতে লিখতে প্রতিবন্ধকতাগুলি পেরিয়ে উঠতে পারব। আর আপনারা যারা আমার লেখা পড়েন নির্দ্বিধায় হাথটি ধরে পথ দেখিয়ে দেবেন। কেমন?


তাহলে কথা রইল, আবার দেখা হবে এই ব্লগেই...।  

Wednesday, September 05, 2012

On Hindsight


We fought like cats and dogs over a trivial issue. But trivial was such a trivia that it was forthwith discarded from our dictionary. Blinding rage wore a magnifying glass shielding clarity of vision, dilating a molehill into a rugged mountain whose peaks were invincible. Lucidity was so pathetically ordinary that we brushed it aside with impatient hands. We had excavated layers and layers of such extra ordinary interpretations to the myriad cornucopia of the very mundane, the very common place.

As a result, we scratched and scarred each other with thorny barbs, sarcastic snide, provocative jibes, sanguinary sneers, razor sharp tongues, and all such means which were more brutal than any other deadly weapon or devastating missile challenging human sovereignty. The apple of discord seemed so important at that point of heated arguments, when we spit mud and gore at each other, that our octaves reached the supersonic till we decided to bang down the phone into each other’s ears and resolved never to speak again.


As the temperature cooled down pity bordering on contempt for the opponent overtook guilt of rubbing salt on each other’s wound. An inflated ego refused to acknowledge faults in behaviour or flaws in perspective. As time passed the moment of insanity receded back to history gradually letting rationality brighten up the day.

On hindsight, winning the argument seemed more important than the actual contention which could have had a simpler solution, a more tranquil rejoinder and also a more amicable finale. But when the mind is fuzzed by the overbearing concern of proving one self right, intelligent handling of an accidentally manhandled situation takes the back seat.

Yes, all word wars are accidents and as the term goes avoidable or with a little care and ease amenable to circumvention. But the ego is quite a fool and rushes in where angels fear to tread resulting in aftermaths which may at times prove beyond repair.

I wish the mind was gifted with more alacrity so that we could clutch in the brake and shift gears escaping the obstructive visual well in time before headlong bumping into it. I wish we could brace ourselves before giving in to torrents of tongue lashing. I wish detached, impartial logic and cool, contained rationalism had the better of us and not snore in one remote corner of our cerebrum or salivate over the discord greedily when these were most needed.


I wish…………..but every such wish is always on hindsight……..isn’t it?

Sunday, August 19, 2012

সাপ্তাহিকী

শেষে বৄষ্টি নামল

অনেক দিন পর ...।

মন মাতানো, ঘর ভাসানো জলোচ্ছ্বাস নয়।  ইলষেগুঁড়ি ও নয়। যখন আপন ছন্দে , আকাশ ঝরে, মধ্য লয়ে, তেমন ধারা বারি বর্ষণ। এ বরিষণ  উদাস করে না। মন ভেজায় না । একাকীত্বের অনুভব করায় না। নস্ট্যাল ? – একেবারেই  না !! শুধু কাপের পর কাপ ধোঁওয়া ওঠা , গরম চা আর কড়কড়া বেগুনি খাওয়ার ইচ্ছা জাগায়। দেখলেন তো বাঙ্গালির মন খাওয়া ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে ?

ব্লগ লিখতে লিখতে এর ই মধ্যে বৄষ্টি থেমে গেছে । তবে আকাশ এখন ও মেঘাচ্ছন্ন । হয়তো আবার...

যাই  রান্না চড়াই গে ।

***

আজকে সকাল থেকে কেন জানিনা ভীষণ বিরক্তি বোধ হচ্ছিল । তাই কোনো কাজই  ঠীক সময় মতো হয়ে ওঠেনি । এমন কি প্রাতঃভোজন ও না (কী মুশকিল আবার সেই খাবার কথা!)। পৌনে এগারোটার সময় দু খানা কড়কড়ে  টোস্টের সঙ্গে পাস্তা সিজনিং দেওয়া গরম-গরম ডিমের ওম্ লেট  খেয়ে তিরিক্ষি মেজাজটা একটু নরম, একটু ধাতস্থ হল ।

***

সব দিন সমান যায় না । এটা শাস্ত্রোক্তি না প্রাজ্ঞোক্তি, জানি না। তবে তলিয়ে দেখলাম কথাটা ঠীক । প্রত্যেক সোমবার ঘুম থেকে উঠে মনে হয়, “উফ! আবার সেই সোমবার। ধুৎ ত্তেরি !!!” খারাপ লাগাটা অহেতুক । জড়তা বোধ  একান্তই মানসিক। ছুটি ফুরিয়ে যাওয়ার দুঃখ নার্সারি থেকে । তাই ব্যারামটা নতুন নয়। গুন গুন করি “ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু”।

সহকর্মীদের সঙ্গে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে দেখেছি প্রতি সোমবারের এই নিয়মিত কিন্তু অকারণ বিষন্নতায় প্রায়সই সবাই ভোগে (রোগটা কী সংক্রামক?)  – অবশ্য কিছু অত্যন্ত কর্মপিপাসু চিনির বলদ ব্যতীত যারা অভ্যাসবশতঃ ঘানি টানতে ভালবাসেন এবং তার জন্য জীবন  উৎসর্গ করতে ও পেছপা হন না। তাঁদের আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও সপ্রশংস অভিনন্দন।

আমি এই শ্রেণী থেকে অবশ্যই বাদ, বলাই বাহুল্য । তবে এটা জেনে আশ্বস্ত হই যে আমি স্বাভাবিক (দ্রাক্ষাফল টক?) মনস্তাত্তিকের অধিকারিণী।

মঙ্গলবার – আর ও কিছুটা নরম্যাল হই -  বাস্তবিকতার সম্মুখীণ, জীবনধারণের তাগিদে দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের  ব্যস্ততায় গা ভাসিয়ে দিই – নিয়ম মাফিক ৯।৩০ – ৫।৩০ আপিসের কাজ অতিশয়  অমানবিক অত্যাচার ও বস্ কে নিতান্তই পাশবিক বলে অতটা মনে হয় না।  

বুধ ও বৄহস্পতিবার কিছু স্ব-সৄষ্ট ডেড লাইন্স ( বাংলা তর্জমাটি কীরুপ হবে – মৄত পঙক্তি না মারণ পঙক্তি ?) এর সংযোজন এবং সময়ানুযাই সেই সব কর্মসূচীর সফল-সমাপ্তির তাড়নায় দুটি দিন হুড় হুড় করে কেটে যায়।       

শুক্রবার – মন ফুরফুরে । অসম্ভব উত্তেজনা ও আনন্দর অনুভূতি। এক অদম্য   উৎসাহে শরীর টগবগে । জীবনে অনেক কিছু করার আছে/ করা চাই / করতে হবে – ক্রমানুসারে এই ধরণের ভাবনা চিন্তা মনকে সম্পূর্ণ রুপে একাধারে আচ্ছন্ন , সতেজ, একাগ্র ও কর্মানুরাগী করে তোলে ।

অবশ্য শুক্রবার রাত থেকেই শরীরে ঢিল । ওঃ ! এখন তো অঢেল সময়! অতএব, বিলাসিতায় গা ভাসানো ( বই পড়া, টিভি/সিনেমা দেখা, গান শোনা, নেটে ঘোরাফেরা, কিছু লেখা, মাঝে মধ্যে  বাহিরভ্রমণ   ইত্যাদি - এও দরকার  কী বলেন ?)

শনিবার/রবিবার – কোথা দিয়ে কেটে যায় বোঝা ভার। এই আটচল্লীশটি ঘন্টায় বাড়ির ও বাইরের যাবতীয় কাজ, আগামী সপ্তাহের তৈয়ারী, পারিবারিক কর্তব্য,  সামাজিকতা রক্ষা এবং সর্বোপরি নিজের কিছু প্যাশনানুসরণ (শেষেরটির জন্য সর্বাধিক কম সময় প্রাপ্তি) । পরিণাম – সময়াভাব ও রবি-বাসর জাগা ।

তারপর ? আবার সেই হ্যাংগওভার...

নীলাভ সোম ( মন্ডে ব্লুর এর চাইতে ভালো বঙ্গানুবাদ পারলাম না)। সত্তর দশকের কার্পেন্টার্সের সেই ঐতিহাসিক গানের কলি মনে পড়ে যায় “ রেইনি ডেজ এ্যান্ড মন্ডেজ অলওয়েজ গেট মী ডাউন...”  

আমার সপ্তাহের দিনপঞ্জিকা যথারিতী কম-বেশী হলেও এই রুপ ।

তবে জানতে ইচ্ছে করে, আপনাদের ও কী ... ?

***

Wednesday, June 13, 2012

শৈশব - ১


আমি যখন ছোট ছিলাম সারাদিন স্বপ্নের রাজ্যে বিচরণ করতে ভালবাসতাম আমাদের বাড়ির সামনে ছিল মস্ত বড় একটা পার্ক   ছাদের ঘরের জানালায় উঁকি মারত বিরাট একটা নিম গাছের ডাল তার কচি, সবুজ পাতাগুলো হাওয়ায় দুলে দুলে হাতছানি দিত আমায় দিনের বেলায় সূর্যের আলোর ঝিকিমিকি পাতার সবুজের উপর যখন খেলা করত তখন সুবর্ণ বনানীর শোভা মন চোখ দুই কেড়ে নিত সেই খেলা দেখতে দেখতে কত যে ঘণ্টা কেটে যেত তা আর বলার নয় বলা বাহুল্য পড়াশোনা  খুব একটা বেশী হত না এবং তাতে মন ছিল না বিশেষ

এখন জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে চোখে পড়ে আকাশ ঢাকা কংক্রিটের বিল্ডিং সামনেই এম সি ডির ছোট একটা পার্ক যেটা অযত্নে জংগলে পরিণত হয়েছে সরকারি মালীগুলো বড়ই বেয়াড়াশত ডাকলেও আসে না তাই পরিষ্কারের পাট অনেক আগেই উঠে গেছে ফলে কিছু আবাসী পার্কটাকে ময়লা ফেলার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে

এই ফ্ল্যাটে আসার পর শখ করে পার্কে একটা নিম গাছের চারা পুঁতে দেওয়া হয়েছিল তখন পার্কটা পার্কই ছিলবনে পরিণত হয়নি সেই চারা আপন উৎসাহেই বেড়ে উঠে বিশাল ছায়া ঘেরা বৃক্ষ হয়ে আকাশের সাথে নীরবে কথোপকথন করত কিছু মাস হল গাছটা দেখি ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে

চড়ুই পাখী আজকাল খুব একটা নজর পড়ে না। দু একটা গাছ ফ্ল্যাটের সামনে পুঁতেছিলাম – পাতাবাহার, ক্রোটন, মানি প্ল্যান্ট, চাঁপা। এবার গরমে দেখি প্রায়ঃ অনেক গাছই ঝলসে পুরে যাচ্ছে।

সেই সোনালীর খেলা, আকাশের মেলা, হাওয়ার দোলা, মন ভোলানো সবুজের ছোঁয়া আর কী কখন ফিরে পাওয়া যাবে ?

তাই ভাবি...        



Friday, June 08, 2012

বালগোপাল

জানালার খড়খডি  দিয়ে সরু রোদের এক ফালি মশারীর গায়ে লেপটে পডার  সাথেসাথেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল । এখানে ভোরের  হাওয়ায়  পাখীর   গান  ভেসে আসে না । গাছই  নেই  তো পাখীর কলরব ! ভোরের শব্দের চেনা সুর একটাই । পূজার  ঘর  থেকে টুং টাং  ঠুং  ঠাং  আওয়াজ   । পিসীর  দিনচর্জা  শুরু । কম করে একটি ঘন্টা ঠাকুরের সেবা যত্ন চলবে । রাতে তাঁদের  শয়ান  দেওয়া হয়েছিল  - এখন  তাঁদের  ওঠানো, চান  করানো , পূজো  দেওয়া , মন্ত্র  পড়া  আর সব শেষে মনে করিয়ে দেওয়া ঠাকুর  আমরাও  আছি একটু দেখো - এই আর কী  । ঠাকুর  দেবতারা যদি এমনি ভাবে ঘুমুতে জান  তাহলে ভক্তদের যে কী  অবস্থা হয়  তা খবরের  কাগজ  পড়লেই  টের  পাওয়া যায়  ।


পিসেমশাই মাঝে মধ্যেই ঠোনা  দিয়ে বলেন ," হু:! ভগবানের আবার এত ঘুম কীসের ?" পিসী  মুখ ঝামটা দিয়ে উত্তর দেন , " দেখো, তুমি আমার পেছনে বেশী লাগতে এস না বোলে  দিলাম" । আমি মুখ  টিপে  হাঁসি আর মজা দেখি ।


পিসীর  যতক্ষণ  পূজো  পর্ব  চলে ততক্ষণ আমার কাজ হলো উঠে চায়ের জল বসানো আর চায়ের সরঞ্জাম গুছিয়ে রাখা । পূজো  পর্বর পর চলে চা পর্ব । এ বাড়ীতে  পর্বের আর শেষ নেই ।পুজো শেষে চায়ের ট্রে  হাথে করে আমার প্রবেশ । পুজোর ঘরের একপাশেই খাবার বড়  টেবিল (ভাড়া বাড়ি তাই জায়গা কম- তবে নিজের  বাড়িতে, যেটা এখন    নির্মাণাধীন , পূজোর  আলাদা ঘর  চাই , পিসী  বলে দিয়েছেন  । আর পিসীর  কথা না শোনা পিসেমশাইয়ের পক্ষে অসম্ভব )। চায়ের ট্রে  রাখতেই পিসী  এসে খাবার টেবিলে বসে পা দোলাবেন কিছুক্ষণ । তারপর চায়ের পটে চায়ের পাতা আর আন্দাজ  মতন  জল  ঢেলে কিছুক্ষণ পুরোনো  দিনের গান গুনগুন করে গাইবেন । চাও বাপু যেসে  নয়  - শ্যামবাজারের  অরফ্যান এর (দোকানের পুরো নামটা আর মনে নেই ) একশো  কুড়ি টাকা কিলো চা - আমি কুড়ি বছর  আগেকার  কথা  বলছি , এখন নিশ্চই  দাম আরও  বেড়ে গেছে । সেই চা বানানোর  কায়দাই  নাকি আলাদা । পিসীর  সময়  গোনা আছে । তিন  মিনিট  কিছু সেকেন্ড  পরে সোনালি  পানীয়  টি পট থেকে   তিনটে  কাপে ঢালা হবে । তারপর  পরিমাণ  মতন দুধ ও চিনি থুড়ি চিনি তো চায়ের কাপে আগেই ঢালা হয়ে গেছে । এ বাড়িতে চায়ের কাপ প্লেটের ওপর খরচ সব চেয়ে বেশী  - নানা বিধ আকার , রং ও কারুকার্য করা কাপ প্লেট কাঁচের আলমারিতে সাজানো পাবে । চায়ের পরিমাণ , রং, স্বাদ, গুন ইত্যাদি কিছুতে  যদি কোনক্রমে একটু এধার ওধার  হ ল  কি মেজাজের সঙ্গে দিনও  খারাপ  যায় ।


পিসীর  একরাশ ঠাকুর দেবতার মধ্যে সব  চেয়ে প্রিয় একটি পিতলের ছোট হামাগুড়ি দেওয়া বালগোপাল । পিসী  নি:সন্তান । তাই  বোধহয়  বাচ্চা কেষ্ট  ঠাকুরের মুর্তিতেই  নিজের  না পাওয়া সন্তানকে খুঁজে বেড়ান । বালগোপালকে  রোজ শোয়ানো , বসানো, খাওয়ানো-দাওয়ানো , ঘুম পাড়ানো আর ঘুম থেকে জাগানো এই নিয়েই পিসীর  দিনের অনেক খানি সময় কেটে যায় । মাঝে পিসির   পিসেমশাইয়ের সঙ্গে একপ্রস্থ কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে -  বালগোপালের  এক খানা সোনার  মুকুট  কিনে দিতেই হবে। পিসেমশাই  গররাজি ছিলেন, পিসী  নাছোড় বান্দা । শেষ পর্যন্ত  স্যাঁকরা  ডেকে  অর্ডার  দেওয়া হয়েছে - কিছু দিনের  মধ্যেই  মুকুট এসে পড়ল বলে ।







চায়ের কেতলিটা গ্যাসে বসানোর সঙ্গে সঙ্গে ঠুক  ঠুক  করে পেছনের দরজায় ঘা ।  । রান্নাঘরের দুটো  দরজা  - পিছনের  আর  সামনের  । সামনের দরজা  দিয়ে হল  ঘর , খাবার  ঘর অর্থাৎ বাড়ির ভিতর এবং বাড়ির লোকেদের  যাতায়াতের  পথ  । পিছনের দরজাটা এক ফালি সরু গলিতে গিয়ে পড়ে । গলি দিয়ে সোজা গেলেই পিছনের দরজা । বাড়ির ঝি , জমাদার , মাছওয়ালা , মালি , সবজিওয়ালা, ইত্যাদির এই পথে আবাগমন । পিসীর পূজোর  ঘরের  জানালাটাও  এই গলিতেই খোলে । এখন  যদিও বন্ধ   । পূজোর  সময়  পিছনের দরজায়  কারোর  আসা পিসী  খুব একটা পছন্দ  করেন না । বিশেষ করে জমাদার । " মরার  দল  ভালো ভাবে পূজোটাও  সারতে  দেবে না " - পিসীর  চিল  চিত্কারে ঠাকুর দেবতার দল এমনিই  ঘুম থেকে ধড়ফ  ড়  করে উঠে পড়ল বলে।


পা টিপে টিপে গিয়ে দরজা খুলে দেখি যা ভেবেছি তাই - একগাল  হলুদ  দেতো  হাঁসি , হাতে ঝাড়ু , ঘর্মাক্ত কলেবর , চুলগুলো  উসকো  খুসকো , গায়ের বেনিয়ানটা জায়গায়  জায়গায় ছেঁড়া আর ধুতিটা ডবল করে হাঁটুর উপর ভাজ করে কোমরে গোজা , পায়ে চটি নেই  । রোজকার ছবি তবুও রোজ দেখে নতুন মনে হয় । আর রোজই  ভাবি পিসিকে  বলব ওকে এক জোড়া নতুন বেনিয়ান আর ধুতি আর পিসেমশাইয়ের পুরনো একটা চটি দেবার কথা । আর রোজই ভুলে যাই ।খুব ই তুচ্ছ   ব্যাপার কিনা তাই ভোলাটাও অবশ্যম্ভাবী ।


এদিকে কল খুলে জল নিয়ে ঝপাক  ঝপাক  করে ঝাড়ু  মারতে শুরু করেছে লোকটা ।নোংরার থলেটা আগেই তুলে নিয়েছে । ও র  ঝাড়ু , বালতি সব আলাদা - পিছনের গলিতেই রাখা থাকে, কেউ  সেগুলোতে হাত দেয় না  ।ও র কাজের অবধি  মিনিট দশেকের ব্যাপার কিন্তু এই মিনিট দশেকই  ভারী পড়ে  যেদিন ও না আসে ।"বাড়িটাকে অপবিত্র করে ছাড়লে " পিসীর  দোষারোপের শেষ   থাকে না ।


জল ভালো ভাবে  কাঁচিয়ে এক গাল হেঁসে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে , " দিদি হয়ে গেছে "। ঘাড়  কাত  করে হাঁসতে হাঁসতে ই  বলে , "আসি তাহলে"। ওর হাঁসিটা বড়  সরল , ছোটো  শিশুর মতন ।  অশিক্ষিত   তবুও ভারী ভদ্র . অমায়িক । আমি বলি ," এস "। দরজার কাছে পৌঁছতে  পৌঁছতে  হঠাত খেয়াল হয় লোকটা রোজ আসে তবুও কখনো ওর নামটা জিজ্ঞাসা করা হয়নি । ডেকে  উঠি "ও ভাই শোনো  । তোমার নামটা জানি কী  ?"


ফিরে দাঁড়িয়ে আবার সেই সরল হাঁসির ছোঁয়া আনে ঠোটের  কোনে । লাজুক ভাবে বলে " আমার নাম ? দিদি , আমার নাম ? বাল  গোপাল । আপনে দিদি আমায় গোপাল বইলা  ডাইকবেন "। আমার মুখে কথা সরে  না । মাথা নেড়ে  সায় দিই  । 


দরজা দিয়ে ফিরে আসতে আসতে গ্যাসের উপর গরম জলের কেতলির হুশ হুশ শব্দ পাই ।পূজোর  ঘরের দরজা খোলার আওয়াজ। পিসির গলা - চেঁচিয়ে বলেন  "কেরে  মিঠু কে ওখানে "? আমি  বলি  , " কেউ না " । মনে মনে  বলি কর্ম   ব্যস্ত , ঘর্মাক্ত , মলিন , জীর্ণ  বস্ত্রে আবৃত গোপাল - তোমার বাড়ি রোজ আসে  যাকে  দ্যুত্কারে , অবহেলায় আমরা রোজ দূরে  সরিয়ে দিই । 


কেতলির মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরোয়  ।  গ্যাস বন্ধ করে দিই । এখন চা পর্বর শুরু । রোজকার কাজে মন দিই ।