বাড়ীটা চোখে দেখিনি । কিন্তু মনের কোণে একটা ছবি আঁকা
আছে - বাগান ঘেরা, বিশাল। বাঁধানো দালান,
বড়-বড় ঘর, বিরাট-বিরাট জানালা আর দরজা, উঁচূ ছাদ লম্বা, টানা দেয়াল ঘেরা। জানালার
কপাটগুলোয় রঙ-বেরঙের কাঁচ বসানো যার মধ্যে দিয়ে সোনা রোদের ঝিলিক খেলা করে ঘরের
মেঝেতে। মা বলেন বাগানে একটা বড় পুকুর ছিল - বাঁধানো ঘাট, ছায়া ঘেরা। স্বচ্ছ
স্ফটিকের মতন জল। জলে বাগানের সবুজ
মিলেমিশে একাকার।
বাগান পেরিয়ে পথ চলে যায় এঁকেবেঁকে প্রবেশ দ্বারের
দিকে যাকে আজকাল কার আধুনিক ভাষায় বলে গেট। গেটের বাইরেই রোয়াক। বৈকালে ছেলেদের
আড্ডা জমে সেখানে আর গুরুজনেরা বসে তামাক টানেন গুড়-গুড় করে মধ্যাহ্নে। গেটের
পাশেই একটা কামিনী গাছ ফুলের ভারে ঝুঁকে পড়েছে রোয়াকের উপর। শ্রান্ত পথিকেরা
প্রায়ঃ ই এসে বসত রোয়াকে। কিছুক্ষণ জিরিয়ে আবার পথ চলার উদ্দ্যম ফিরে পেত।
আর এসে বসত সেই মেয়েটি – এক পীঠ এলো চুল, কপালে
সিঁদুরের টক্ টকে টিপ, লাল পাড় সাদা সারি। ভারী মায়া জাগানো মুখের শ্রী কিন্তু চোখ
দুটি বড়ই উদাসীন। বাড়ীর পাশেই সিদ্ধেশ্বরী
দেবীর মন্দির। মন্দিরের পিছনে নদী বয়ে যায় কুল কুল করে - কী নাম জানি। কতদিন সেই
মেয়ে মন্দিরের ঘাটলায় বসে থাকে বিষণ্ণ মনে। নদীর শান্ত প্রবাহে কী যেন খোঁজে। নতুবা চেয়ে থাকে উদাস চোখে দূর দিগন্ত
পাণে যেখানে আকাশ মেশে পৃথিবীর বুকে। সংসারে তাঁর মন বসে না। শ্বাশুড়ীর গঞ্জনা, প্রতিবেশীদের টিটকারী, আত্মীয় স্বজনের খিটিমিটি
সবই সে অগ্রাহ্য করে, কিছুই তাঁর গায়ে লাগে না।
একদিন ভর দুপুরে বাড়ী ফেরার পথে ছায়া-স্নিগ্ধ রোয়াকে
এসে বসে সেই মেয়েটি। বাড়ীর কর্তা তখন বাগানেই পায়চারী করছিলেন। অবেলায় ক্লান্ত
মেয়েটিকে বাইরে বসে থাকতে দেখে সস্নেহে ডেকে বলেন, “বাইরে কেন মা? ভিতরে এসে ব’স”।
মেয়েটি উত্তর দেয়, “আপনি যখন মা বলে ডেকেছেন,
তখন আমি আপনাকে বাবা বলেই সম্বধোন করি”। কর্তা বলেন, “ বেশ তবে তাই হোক। আজ থেকে তুমি
আমার আরেক মেয়ে হ’লে। তবে আর বাইরে কেন ভিতরে এস”। মেয়ে বলে, “না বাবা! আমি ভিতরে
আসব না। এখানেই বেশ আছি”।
সেই থেকে শুরু এক অভিনব সম্পর্কের। বাড়ীর কর্তা হলেন
বাবা আর গিন্নী হলেন মা। তবে মেয়েটিকে কিছুতেই ঘরের ভিতরে আনতে পারেননি কর্তা। শুধু
কামিনী গাছটি বাবা-মেয়ের এই অদ্ভুত সম্পর্কের টানকে প্রত্যক্ষ করেছে নীরবে।
শহর ঢাকা। ইংরাজী সন ১৯৪৭ সালের ও কিছু বৎসর আগের
কথা।
তারপর কেটে গেছে কত বছর। সেই মেয়েটির হয়েছে জগত জোড়া
নামডাক। সবাই মা বলতে অজ্ঞ্যান।কত সেবক-শিষ্য-অনুচর বৃন্দ তাঁর – ডাকসাইটে নেতা,
গণ্যমান্য ব্যক্তিগন, সমাজের প্রতিনিধি যাঁরা। কিন্তু এত খ্যাতি-মান সত্ত্বেও ভোলেনি
সে সেই ঢাকার দিনগুলি। “মা ঢাকার অমুক বাড়ীর মেয়ে এসেছেন দেখা করতে” বলার
সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর খাস অনুচর এসে মায়ের ঘরে সোজা নিয়ে গিয়েছে অপেক্ষমানাকে। বাইরে এক
মুহূর্তও সহস্র দর্শনার্থীদের ভীড়ে লাইন দিয়ে দাঁড়াতে হয়নি।
এসব এখন গল্প মনে হয়। তবে মাঝে-মাঝে বড় ইচ্ছে করে সেই
শহর, সেই পল্লী, সেই পথ যদি ফিরে পাওয়া যেত। ছুটে চলে যেতাম ...কিন্তু কোথায়?
আছে কী সেই ঢাকা শহর, সেই বাগান-ঘেরা বাড়ী,
সিদ্ধেশ্বরী দেবীর সেই মন্দির আর সেই ফুলের ভারে নুয়ে পড়া কামিনী গাছ?
তবুও কেন জানিনা...
সত্যিই ভিটের টান বড়ই সাংঘাতিক!!
সত্যিই ভিটের টান বড়ই সাংঘাতিক!!
ReplyDeleteএক্কেবারে সত্যি কথা
লেখাটায় কার কথা বলেছেন জানি না....তবে ভাল হয়েছে
আমার শৈশবের এক টুকড়ো, সবুজ। নাম ইচ্ছে করেই গোপন রাখলাম। গীতশ্রী
ReplyDeleteআপনার লেখাটি আরেকবার পড়লাম ....মনে পড়ে গেল দেশভাগের উত্তাল দিনগুলি নিয়ে সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহর লেখা "একটি তুলসী গাছের কাহিনী " গল্পের কথা ...শৈশবের দিকে তাকালে আমাদের মনে সবচেয়ে দাগ কেটে যাওয়া স্মৃতিগুলোই ভেসে উঠে...আছে কী সেই ঢাকা শহর, সেই বাগান-ঘেরা বাড়ী, সিদ্ধেশ্বরী দেবীর সেই মন্দির আর সেই ফুলের ভারে নুয়ে পড়া কামিনী গাছ?...স্মৃতিকাতরতা!!!..যাই হোক ..ফেইসবুকে আপনাকেতো দেখাই যায় না ..একদিন সময় করে বসুন না ...কথা হবে
Deleteসবুজ, আপনার বিশ্লেষণাত্মক টিপ্পণী ভাল লাগল। ঠীকই ধরেছেন ফেসবুক ব্যাপারটা আমার ধাতে সয় না । তবে আপনার অনুরোধ ফেলতে পারব না। দেখা হবে খূব শীঘ্রই। গীতশ্রী
DeleteKhub sundor lekha...pore bhalo laglo
ReplyDeleteইন্দ্রানী, মন ভরে গেল তোমার ভালো লেগেছে জেনে। আশা করি আবার দেখা হবে। কোথায়? এই ব্লগে...আর কী? তুমি বললাম, আশা করি কিছু মনে করলে না । গীতশ্রী
ReplyDeleteatiter grammya Flash back aaar bartamaner modernity abong industrialisation ar conflict.....partition ar kure khawa kanna a lekhai phute beriache.Khub sundar jhor jhore lekha ....prothom bhorer siuli phuler moto pore chilo ajante agane....Aajer sokal ta aapnar lekha aamake purna korlo. dhonyobad.[Janina aanya kono jati desh bhag niye aato smriti charon koreche....chek korte hobe Punjab, Germany, USSR....]
ReplyDeleteঅজস্র ধন্যবাদ। আমার ব্লগে আপনার পদার্পণ এক রাশ ভালো লাগা এনে দিল।
ReplyDeleteগীতশ্রী
এই ছড়াটি পড়ে আপনার লেখাটির কথা মনে পড়ে গেল
ReplyDeletehttp://sabujmohiminul.wordpress.com/2012/11/13/khuko/
ReplyDeleteভালো লাগল।