Saturday, June 28, 2025

পথিক! তুমি কি পথ হারাইয়াছো?

জীবনে প্রতি নিয়ত অনেক লোকের সংস্পর্শে আসা এবং তাঁদের আমাদের ব্যক্তিত্বের ও জীবন যাত্রার উপর নানা বিধ প্রভাব - এই অনুভূতি, এই আদান প্রদান, এই অভিজ্ঞতাগুলিই জীবন যাত্রার পাথেয় হয়ে দাঁড়ায়। এই সহ যাত্রীরা সব সময় আপনজনের তালিকা ভুক্ত নাও হতে পারে। অনেক এমন লোকের সাহচর্য পাওয়া যায় যারা প্রাথমিক ভাবে সম্পূর্ণ রূপে অপরিচিত কিন্তু তাঁদের ক্রমাগত সান্নিধ্য  তাঁদের আন্তরিক ভাবে পরিচিত  ও আপন করে তোলে। তাঁরা কখনো বন্ধু কখনো বরেণ্য কখনো অযাচিত ভাবে উপকার করে আমাদের ঋণগ্রস্ত করে রাখে সারাটা জীবন।

আবার কিছু কিছু এমন লোক আছে যারা আমাদের জীবনে কিয়ৎক্ষণ দেখা দেন আর তারপর কোথায় মিলিয়ে জান। তার মানে এই নয় যে তাঁরা স্মৃতি থেকে অবলুপ্ত হয়ে যান। বরঞ্চ এর উল্টোটাই হয় - তাঁরা বার বার মনের দরজা দিয়ে উঁকি মারেন। ভাবি এঁদের সঙ্গে যদি আরো ঘনিষ্ট পরিচয় হত তাহলে জীবনটা কি অন্য খাতে বইত?

তিনটি উদাহরণ দিই।

কলকাতায় কর্মসূত্রে কিছুকাল থাকাকালীন প্রায়শই দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার সুযোগ পেতাম। মায়ের মন্দিরের সামনেই নাট মন্দিরে সন্ধ্যাকালে গানের আসর বসত। ভক্তিরসে সিক্ত সেই সব সভায় সম্মিলিত হওয়া বিশেষ ভাগ্যের ব্যাপার মনে করতাম। এইরকমই একটি শ্যামা সঙ্গীতের আসরে এক মাদল বাদকের ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট হই। লম্বা মেদহীন গঠন । সুপুরুষ বলা চলে। খুব প্রাণ দিয়ে মাদল বাজালেন। মনে হলো বাদ্য যন্ত্রের মাধ্যমে যেন মায়ের আরাধনা করছেন। পরে তাঁর আরেক ব্যক্তির সঙ্গে কথপোকথন শুনে জানতে পারি যে উনি অনেক বছর পড়াশোনা শেষ করে বেকার ছিলেন। তখন মায়ের মন্দিরে প্রায় আসা যাওয়া করতেন। ইদানিং বিদেশে কর্মরত হওয়ার দরুন মায়ের দরবারে নিয়মিত হাজিরা দিতে অসমর্থ হলে ও যখনই সুযোগ পান চলে আসেন। শুনে মনে হয়েছিল এই লোকটিকে আরেকটু ভালো ভাবে জানতে পারলে মন্দ হত না। তবে সে সুযোগ আর হয়নি।

দ্বিতীয় জন আমার বাসের সহযাত্রী। প্রতিবেশী ও বটে। মাঝারি গড়ন। একমুখ দাঁড়ি। মধ্যবয়সী। কোনোদিন কথা হয়নি। পাশে বসেও না। ভদ্রলোকের মধ্যে একটা খেলোয়াড় খেলোয়াড় ভাব ছিল। হয়তো আলাপ হলে আরো ভালো ভাবে তাঁকে জানা যেত। হয়তো পরিচিতির ফলে আকর্ষন ও কিছুটা কমত। কিন্তু কোনোদিন তাঁর সঙ্গে কথপোকথন হয়নি এমনকি আবহাওয়া নিয়েও নয়। তারপর একদিন জানতে পারলাম ...যাক সে কথা...

তৃতীয় ঘটনাটি আরো মর্মান্তিক। বেঁটেখাট মানুষটি আমার সঙ্গে কথা বলতে ভীষণ উদগ্রীব। পাতলা শরীর। মাথাটা দেহের অনুপাতে বড়। আলাপ করতে চেয়েছিল। আমি করিনি। "অনেক কথা বলার আছে কিন্তু কী করে বলি বুঝতে পারছি না"। মনে মনে বলি, "তাহলে আর বলে কাজ নেই"। মুখ ঘুরিয়ে রাস্তা পার করি। এর পর আর কোনোদিন কথা বলার চেষ্টা সে করেনি।  কিন্তু একদিন আমার ব্যাগ থেকে টাকা পড়ে যেতে সেটা সসম্ভ্রমে আমাকে তুলে দেন। এখন ভাবি আমার তাঁর প্রতি এত উদাসীনতা হয়তো তাকে মনে কষ্ট দিয়েছে। হয়তো সে একজন নিপাট ভালো মানুষ ছিল। দু একটা কথা বললে কারোরই কোনো ক্ষতি হত না। কিন্তু সে সময় পেরিয়ে গেছে। রেখে গেছে শুধু আফসোস।

এরকম আরো অনেক ঘটনা... বলতে গেলে রাত কাবার হবে। এখন মনে করেও কোনো লাভ নেই। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ মনের দরজায় এরা টোকা যে মারে! তখন ভাবি এই সব বিস্মৃত মানুষরা কেন আসে মনের আঙিনায়? কি চায় তাঁরা? আমি কি চাই? এদের নাম দিতে?  কি নাম দেব? এদের পরিচয় কি? এরা তো সব আগন্তুক। তবে???

Friday, April 11, 2025

আসলে নকল




অনেকদিন পর একটা বাংলা ওয়েব সিরিজ দেখলাম। নারায়ণ সান্যালের সোনার কাঁটা অবলম্বনে । সিরিজটির নাম "কাঁটায় কাঁটায়"। খারাপ লাগলো না তবে...

ওই তবেটাই হলো মুশকিল। একবার পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে বসলে আর শেষ নেই। 

ছোটো করে বলি ।

এডভোকেট পী কে বাসু  সুজাতা মিত্র বলে একটি সুন্দরী মহিলাকে খুনের দায় থেকে বাঁচাতে গিয়ে কেতন দেসাই নামক ব্যবসাদারের পার্টনার কে দোষী সাব্যস্ত করেন। আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। জেলে থাকা কালীন আসামি (নাম ভুলে গেছি) একটি চিঠি লিখে জানান যে তিনি ন্যায়ের সেবা করতে গিয়েই খুনটা করেছেন। অতএব তিনি দোষী নন। যেহেতু কেউ তাকে বিশ্বাস করে না বা করবে না তিনি তাই আত্মহত্যা করাই বেছে নেন । এরপর এই মামলায় যুক্ত সবাই এক এক করে খুন হতে থাকেন। একটি দুর্ঘটনায় পী কে বাসুর কন্যাও মারা যায়। 

এদিকে সুজাতা কৌশিক দার্জিলিংয়ের কাছে একটি রিসর্ট খুলবে ঠিক করে। বলা হয়নি কৌশিক সুজাতার কেসে অভিযুক্ত ছিল। কেতন কে মারার জন্য দুটো গুলি চলে। একটি সুজাতার পিস্তল থেকে আরেকটা আততায়ীর আগ্নেয়াস্ত্র থেকে। কৌশিক ঘটনাস্থলে পৌঁছে সুজাতার হাত থেকে বন্দুকটি নিজের হাতে নিয়ে নেয় যাতে সে দোষী সাব্যস্ত হতে পারে। কিন্ত রাখে হরি মারে কে? কৌশিক আসল খুনী ধরা পড়ায় সসম্মানে ছাড়া পায়। 

তারপর প্রেম আরো গাঢ় হয়। আঁঠা হয়ে বিবাহ বন্ধনে সুজাতা কৌশিক আঁট হয়ে যায়। অতঃপর দার্জিলিং -  যেখানে কেতন দেসাই মামলার সঙ্গে সপক্ষে বিপক্ষে যারাই যুক্ত তাঁরা সবাই আমন্ত্রিত হয় রিসর্টের লাল ফিতে কাটার জন্য। এই আমন্ত্রিতদের মধ্যে খুনী ও শামিল। এরপর একে একে খুন হতে হতে বেঁচে যাওয়া। এবং শেষ মেষ  বাসু বাবুর গোয়েন্দাগিরির সুফল স্বরূপ ঘাতকের ধরা পড়া।

এবার ছাড়াই পেঁয়াজের খোসা ...

সুজাতা কেতন মামলার কথা বলি । সুজাতাকে কেতন নিজের বাংলো তে রাত্রি বেলা ডাকতেই সে কেনো গিয়ে হাজির হলো ?

ভালো মেয়েরা এরকম মাথামোটা কাজ করে ?

আরে নিজের সুরক্ষা তো নিজেকেই ভাবতে হয়। সুজাতা কী ভেবেছিল ? গড়বড় দেখলে গুলি চালিয়ে দেবে। তারপর কৌশিক তো আছেই ?

আচ্ছা তা নয় হলো কিন্তু সুজাতা পিস্তল কোথা থেকে পেলো ? পিস্তলের লাইসেন্স ছিল কি? কৌশিক ওখানে কী করে পৌঁছলো ? ভীষন বেশি কাকতালীয় হয় গেলো নয় কি ?

এবার কোর্ট  সীন।

এডভোকেট বাসু জজ সাহেব কে আততায়ীর গতিবিধি সম্বন্ধে অবগত করাতে গিয়ে বললেন " আমার মনে নয় ..." এই ভাবে আর কি খুনটি হয়েছে। "আমার মনে হয়..."? না হয় উচিত "আমার বিশ্বাস..."? সংলাপটি শুনে কানে খোঁচা লাগলো। আরে এডভোকেট সাহাব কানূন সবুত মাংতা হ্যায় "আমার মনে হয়" নেহি।

আসি দার্জিলিংয়ে।

ইন্সপেক্টর রমেন, যিনি সুজাতার কেসে ইনভেস্টিগেশন অফিসার ছিল, এখন দার্জিলিংয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা হোটেলে, যেখানে বাসু বাবু সস্ত্রীক উঠেছেন, এসে হাজির। মামলার পরবর্তী খুনগুলির ইনভেস্টিগেশন ও তাঁর হাতে। কিন্তু ইতিমধ্যে তিনি কেটি নামক এক নাইট ক্লাব সিঙ্গারের প্রেমে হাবু ডুবু খেয়ে পুলিশি কার্যকলাপ ও গতিবিধির কনফিডেনসিয়াল খবরাখবর নির্দ্বিধায় মেয়েটির সামনে ফোনে আলোচনা করে নিজের জীবনাবসানের পথ নিজেই প্রশস্ত করে ফেলেন। কেটি রমেন কে লাখ টাকার বিনিময়ে খুন করে। একজন দুদে পুলিশ অফিসার কী করে প্রেমে এরকম ভাবে ক্যালাতে পারে ?

রিসর্টে আসি।

প্লটটিকে ঘোরালো করার জন্য নানান হাইলি সাস্পিসিয়াস চরিত্রের সুজাতা কৌশিকের রিসর্টে অবতরণ । একজন ডাক্তার আর তার স্ত্রী যার সুজাতা মিত্র কেসের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। একটি কথায় কথায় ধুমপানরতা দারুন স্টাইলিশ মহিলা এবং একটি আর্টিস্ট ছোকরা । একজন বার্কলে ইউনিভার্সিটির শিক্ষক যার বিনা অনুমতিতে যার তার ফোন ক্লিক করে ছবি তোলার শখ।

ডাক্তারের স্ত্রীর আবার সবরকম মনোবৈজ্ঞানিক রোগ আছে - ক্লেপটোম্যানিয়া ,  ঘুমের ঘোরে চলা মানে সোমনামবুলিসম ইত্যাদি।

তারপরে যা হয়ে থাকে। 

বরফ... ঝড়... ফোনের তার কাটা... যোগাযোগ বন্ধ... এর মধ্যে বাসু বাবুর অনুরোধে দার্জিলিঙ পুলিশের এক অফিসার রিসর্টে এসে হাজির খুনী কে ধরার জন্য... ইয়ে মানে বাসু বাবুকে খুনীকে ধরার্থে হেল্প করার জন্য। তিনি এসেই সবাইকে সন্দেহের চোখে দ্যাখা আর জেরা শুরু করা। জেরার ফাঁদে এমন কি বাসু বাবু পর্যন্ত জড়িত। 
দারুন সিনসিয়ার পুলিশ.. হুঁ হুঁ । 

এর পরে আর স্পয়লার না দিয়ে একটা ছোট্ট হিন্ট দিয়ে পেঁয়াজের খোশা ছাড়ানো বন্ধ করি।  যারা যারা আগাথা কৃষ্টির মাউসট্র্যাপ গল্পটি পড়েছেন তার সঙ্গে কাঁটায় কাঁটায়ের শেষ ক্লাইমেক্সের হুবহু সাদৃশ্য খুঁজে পাবেন। এটা কি কাকতালীয়? অথবা যাকে বলে ইনস্পায়ার্ড? না সম্পূর্ণ ভাবে লিফটেড ?

তবে পুরো সিরিজটা  দ্যেখার পর একটাই কথা মনে হয়। এত জল ঘোলা না করে সোজাসুজি কেতন দেসাইয়ের খুনের মামলায় অভিযুক্ত লোকটি  কাকে চিঠী বা সুইসাইড নোটটা লিখেছিল সেটার খোঁজ করলেই তো খুনী সহজেই ধরা পড়ে যেত । নয় কি ? কেনো চিঠিটি যাকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছিল তার পরিচয় শুরুতেই পাওয়া গেলো না বা ধরা পড়ল না সেটা বোধগম্য হলো না তো। 

হ্যাঁ তবে এত সহজেই খুনী ধরা পড়লে গল্পের গরু গাছে উঠতে পারত না তা ঠিক ।