দু:খের বিষয়। কিন্তু এই নিয়ে কোনো জাতিকে অবমাননা করবো না। কারণ আমরা সবাই কুপমণ্ডুক। নিজেদের সামাজিক গন্ডির বাইরে কত টুকুই বা জানি বা খোঁজ রাখি ?
বলাই বাহুল্য বেশি কিছু বলেও লাভ নেই। বললেও কি বলব? আমাদের সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের পাশে বিরাট বসত বাড়ি ছিল? শান্ত পুকুর ঘিরে অনেক খানি জমির উপর বাগান - ছায়া ভরা গাছগুলির প্রতিচ্ছবি পুকুরের জলে স্থির হয়ে থাকতো? আর সেই যে বাগানের গেটের উপর কামিনী ফুলের চাঁদোয়া? ফুল ঝরে পড়ত গেটের বাইরে রোয়াকে।
কত লোক যাতায়াতের পথে সেই রোয়াকে বসে জিরিয়ে নিত। তাঁদেরই মতন আর এসে বসত একটি মেয়ে। সদ্য বিবাহিতা। স্বামী ও শ্বাশুড়ির হাতে নির্যাতিতা। প্রায়ই দ্যাখা যেতো তাঁকে এলো চুলে মন্দিরের পিছনে নদী পারের ঘাটলায় উদাস নেত্রে বসে থাকতে। তখনও সে বিশ্ববন্দনীয়া হননি।
একদিন তিনি এসে বসেছেন আমাদের বাড়ির রোয়াকে। দাদু বাগানে পায়চারি করতে করতে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পড়া অল্পবয়সী মেয়েটিকে দেখে বললেন, "বাইরে কেন মা? ভিতরে এসে বসো।" মেয়েটি মাথা নোয়ালেন। না তিনি ভিতরে আসবেন না। ততক্ষণে দিদিমা বাইরে এসে পড়েছেন। বললেন , " লজ্জা কিসের মা? তুমি তো আমার মেয়ের মতন।" মেয়েটি নত শীরে উত্তর দিলেন, " মা, আমি ঘরে পা দেব না। তবে আপনি আমায় মেয়ে বলে ডেকেছেন, আজ থেকে আপনাদের মা আর বাবা বলেই জানবো।"
সেদিন থেকে ওই পাতানো কন্যাটির সঙ্গে এ বাড়ির রক্তের চেয়েও প্রগাঢ় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমার এক মাসির সঙ্গে ছিল তার সহদরার মতন ভাব।
এরপর অনেক বছর কেটে গেছে । সাধনার অনেক উচ্চ স্থানে পৌঁছে ও রাজনৈতিক পরিপৃষ্ঠতা পেয়েও তিনি বৈরাগীই রয়ে গেছিলেন। দিল্লীতে শতেক শিষ্য গণ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে কখনো এসেছেন। আমার মা ছুটে গেছেন তাঁকে দেখতে। হাজার খানেক লোকের লাইন অবজ্ঞা করে শুধু মাত্র বলে পাঠিয়েছেন : " রাজশাহী থেকে রাজমোহন বাবুর ছোট মেয়ে এসেছেন দ্যাখা করতে।" অমনি ডাক পড়েছে ।
শিশু সুলভ আনন্দে ভরে উঠেছেন। পরিবারের প্রত্যেকের নাম নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবরাখবর নিয়েছেন। মার হাতে তুলে দিয়েছেন আশির্বাদ স্বরূপ কখনো কিছু কখনো কিছু।
খুব ইচ্ছে ছিল সেই মন্দির দ্যাখার। সেই পুকুর পাড়। সেই বসত বাড়ি। সেই কামিনী গাছের ছায়ায় মোড়া রোয়াক খানি। হয়তো বিধ্বংসী বন্থিশিখা জ্বলার আগেই ছারখার হয়ে গেছে সেই সব স্মৃতিচিহ্নগুলি ।
হয়তো সেই বাড়ি আর নেই। নেই সেই পুকুর। কামিনী গাছের ছায়া ঘেরা রোয়াক । কিন্তু মন্দির? মন্দির তো ছিল নাম করা। অনেক ভক্তগণের আরাধ্যা দেবীর ঝলমলে আসন।
ভগবান কে কি হত্যা করা যায় ?
জ্বালিয়ে নাশ করা যায় ?
ইতিহাসের মতন মুছে ফেলা যায় ?
নতুন ইতিহাস গড়ার আগে কি সেই অবিনশ্বরকে একবার ডাক দেবে না সময়?
" হে পরমেশ্বর চেয়ে দ্যাখো তোমার স্মৃতি সৌধ মুছে ফেলে নতুন ধর্মের আবাহন করছি আমরা অমৃতস্য পুত্রা:।"
"আশির্বাদ কর আমরা যাতে সফলকাম হই!"