'অ' বাবু
আমার পড়শী। ছাপোষা মানুষ। হাঁসি হাঁসি মুখ; ভীরু-ভীরু চাউনি ; নরম গলার আওয়াজ। নিরীহ গোছের
ভালো লোক। আজকের ছোটাছুটির জীবনে উনি এক রকমের ব্যতিক্রম বটে। ব্যতিক্রমের
কথায় পরে আসছি। আগে বলি এই নিরীহ ও ভদ্র হওয়ার অপাংঙ্কত্তেও যোগসাযোগের বিষয়ে। আজগের যুগে যে ভদ্র সে নিরীহ তো বটেই। আবার
যে নিরীহ সে অনায়াসেই ভদ্র লোকের পর্যায় পড়েই যায়। কারণ ভদ্র মানেই ভীত,
সন্ত্রস্ত, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না, মুখ তুলে তাকাতে সাহস করে না, নির্ভীক চিত্তে
প্রতিবাদ করতে ও পারে না বা রুখে দাঁড়াতে ও অক্ষম। এ জাতীয় মানুষ কে আমরা
সাধারণতঃ ভদ্র লোক ব’লে জানি। উনি খুব ভদ্র কোনো ব্যাপারে সাতেও নেই আর পাঁচেও
নেই। এটা আমাদের সামাজিক বললে ভুল হবে, বরং
বলব ‘সভ্য’ হবার মাপদন্ডের একটি অলিখিত আইন। যে সভ্য তাঁর মাথা নত। যে যত
বেশী অসভ্য তাঁর গলার বৈকি গায়ের জোর ও ততধিক।
বিষয়টা গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। কথার মোড়
ঘোরাই। আসি আমাদের ‘অ’ বাবুর প্রসঙ্গে। আর
প্রথমে যা বলেছি তা আবার বলি। ‘অ’ বাবু শান্তি প্রিয় মানুষ। মুখে রা নেই। তবে কেন
তাকে নিয়ে আলোচনা? শান্ত, অবিচল, নিয়মবদ্ধ জীবন সম্বন্ধে বলার বিশেষ কিছুই থাকে না
কারন সেই জীবনে কোনো চাঞ্চল্য, কোনো এক্সাইট্মেন্ট, কোনো ওঠা-পড়া নেই। একই প্রবাহে জীবন কেটে যায় নিশ্চিত
গতিতে। এই নিশ্চিত ধারাবাহিকতায় রোমাঞ্চ কোথায়? কোথায় গল্প? কোথায় না-পাওয়ার
ব্যথা? কোথায় অযথা ক্লেষ? শান্ত-শিষ্ট ল্যজ বিশিষ্টরা সব কিছু অক্লেষে মেনে নেয়।
এই মেনে নেওয়াতেই সোয়াস্তি। আবার এই অক্লান্ত মানিয়ে নেওয়ার মধ্যেই বোধহয় আরেক
ধরণের বেঁচে থাকার স্বাদ, মোহাচ্ছন্নরা যেই স্বাদ থেকে বঞ্চিত।
আগেই বলেছি ‘অ’ বাবু একটি ব্যতিকম। ব্যতিক্রমটি
কী এবার বলি। না, তিনি স্বভাবসুলভ মিতভাষী, স্মিতহাস্য কিম্বা অমায়িক – এগুলো তাঁর
গুণ হতে পারে কিন্তু ব্যতিক্রম নয়। ব্যতিক্রম তাঁর একটিই। সেটা হল এই ছোটাছুটির
জীবনেও তিনি যেন তূষারপিন্ডের মতন শীতল। যাই বলি না কেন তাঁর মুখে চঞ্চলতার কোনো রেষ
আঁকে না। শুধু আমি কেন কারও কথাতেই সেই নিষ্পৃহতায় ব্যাঘাত ঘটে না। নিষ্পৃহ বললে ভুল হবে। এক প্রগাঢ় প্রশান্তিতে
তাঁর মিখমন্ডল সব সময় ভাসিত। সেদিন কী একটা চাইতে এসে লাজুক ভাবে মুখ নীচু করে ব’ললেন,
“দিদি যখন সময় হবে দিয়ে দেবেন। আমার কোনো তাড়া নেই”। এই “আমার কোনো তাড়া নেই”
সাধারণ চারটি শব্দ ওনার মুখে লেগেই আছে। যে যাই বলুক না কেন। আর এই
চারটি শব্দই আমায় বিশেষ করে নাড়া দিয়ে যায়
যখন দেখি সময়াভাবে মানুষ মানুষের সঙ্গে সাধারণ আলাপচারিতার ও সুযোগ করে উঠতে পারে না। এই অহরহ ছোটার তাগিদে আমিও শামিল। ‘অ’ বাবুকে
হিংসে হয়। মাঝে-মাঝে মনে হয় সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবন-যাপনরত, অজস্র অভাব-অনটন সত্যেও
‘অ’ বাবু কত সুখি, কত ধনি। আবার ভাবি উনি কী জীবনের সঙ্গে চরম বোঝাপড়া করে ফেলেছেন
না জীবনটাকে সত্যি পরিপূর্ণ রূপে জিইয়ে নেবার চাবিকাঠি খুঁজে পেয়েছেন?
ভাবি কিন্তু এখনো উত্তর পাইনি। কারণ এহেন
মানষিকতা আমায় যতই প্রভাবিত করুক না কেন আমি এ ধরণের নির্বিকারতা থেকে এখনো
বঞ্চিত। হয়তো কোনো দিনই আমি ‘অ’ বাবুর মতন বাচঁতে বা ভাবতে পারব না।
তবু ও...। আপনাদের কী মনে হয়?