Monday, July 20, 2015

কিছু গান কিছু জ্ঞ্যান



গ্রেট মিউজিক গুরুকুল দেখছেন? কালার্স বাংলায় সোম থেকে শনি রাত নটা থেকে দশটা আর রবিবার একই সময় আন্ কাট ভার্সান  । যারা গান ভালোবাসেন ও গায়েকী বোঝেন তারা এই প্রোগ্রামটা একদম মিস করবেন না।


আমি গান ভালোবাসি কিন্তু গান বা গায়েকী সম্বন্ধে লেখার ব্যাপারে অনভিজ্ঞ তো বটেই আবার ইতস্তত ও করি। গান শোনা বা গান বোঝা এক জিনিস আর গান বা গায়েকী সম্বন্ধে লেখাজোখা করা আরেক জিনিস। তার জন্য পেটে অনেক বুদ্ধি থাকা দরকার যা আমার নেই।  

কিন্তু এই প্রোগ্রামটা ভালো লাগার পেছনে অনেক কারণ আছে। একে একে বলি-
১ প্রোগ্রামের ফর্ম্যাট  - অন্য প্রোগ্রামের তুলনায় খুব ভিন্ন না হলেও বেশ আকর্ষক

২ প্রোগ্রাম পরিচালনা - পরিষ্কার , পরিচ্ছন্ন, গোছালো, অত্যধিক ভাবপ্রবনতা বিহীন

৩ বিচারক মন্ডলী -  প্রতিযোগীতা থাকলে বিচার করার লোকের তো প্রয়োজন হবেই

৪ প্রতিভাগীর দল – প্রত্যেকের রেয়াজী গলা ও স্টেজের অভিজ্ঞতার অভাব নেই

৫ কম্পেয়ারিং – মার্জিত ও একই সাথে মজার ও

৬ প্রোগ্রামের মূল মন্ত্র – গান, গান আর আরো ভাল গান

সব মিলিয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ এক নাগাড়ে দেখলেও এখনো পর্যন্ত বোরিং বলে চ্যানেল ফ্লিক করিনি এটাই প্রোগ্রামের গুনমানের পরিচায়ক। 


 এবার বিষদ আলোচনায় এগোই -

প্রোগ্রামের ফর্ম্যাট অনুযায়ী প্রথমেই একরাশ কিশোর-কিশোরীদের  মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া হল চব্বিশ জন ছেলে-মেয়েকে (দুটি বাচ্চা ও আছে) যারা প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহণ করার উপযুক্ত বলে বিচারকদের মনে ধরলমনে ধরা মানে নিজস্ব পক্ষপাতিত্ব অনুসারে চয়ন নয়। রিতিমত গায়েকীর  কুশলতা পরখ করে বাছা। তারপর তাদের বাজিয়ে দেখা মানে তাদের দিয়ে নানান ভিন্নধর্মী গান গাইয়ে জহুরীর মতন পুঙ্খানুপুঙ্খ রুপে নিখাদ সোনা বাছাই করা। শেষমেষ শুরু হল এলিমিনেশন রাঊন্ড। এই শেষের ব্যাপারটাই সবচেয়ে পীড়াদায়ক যখন আশাহত হয়ে এক-এক করে প্রতিযোগীতা থেকে অংশগ্রাহক বাদ যেতে থাকে। কিন্তু এরই মধ্যে আমরা পাই অনেক সাহসী মনের পরিচয় যারা বাদ গিয়েও হাঁসি মুখে হার স্বীকার ক’রে বাকী যারা আছেন তাদের শুভেচ্ছা জানিয়ে যায় - এরাই আসল মানের খেলোয়াড়। জীবন যুদ্ধে এরাই সর্বোপরী জয়ী।

চয়নের সময় কম্পেয়ারিংএ ছিল ঈমন ও আরেকটি মিষ্টিমুখ ছেলে যার নাম আমি ঠীক জানিনা। পরের দিকে যখন আসল প্রতিযোগীতা আরম্ভ হল তখন মঞ্চ-উপস্থাপনার ভার পড়ল যার উপর তার নাম সাহেব। আমি সাহেবকে আগে কখন দেখিনি। তবে ছেলেটির  উপস্থাপনা সত্যিই ভালো। আনন্দ, কলহ, ঠাট্টা-তামাশা, ফষ্টি-নষ্টি মিলিয়ে খুবই মজাদার  পারফর্মেন্স – যাকে বলে সলিড এন্টারটেনমেন্ট।

গ্রেট মিউজিক গুরুকুল এর অসলি টী আর পী হচ্ছে এর বিচারকের প্যানেল। এঁরা হলেন –

১ গায়ক শ্রেষ্ঠ এ হরিহরণ

২ সুরের রানি কবিতা কৄষ্ণমুর্তি

৩ বাঙ্গালীর প্রিয় (বাঙ্গালী) বাবু জাভেদ আলী আর

৪ বাংলার গর্ব জীৎ গাঙ্গুলী


হরিহরণ সম্বন্ধে কিছু বলাই ধৄষ্টতা। তিনি একজন লিভিং লেজেন্ড – জীবন্ত কিংবদন্তী। কবিতা কৄষ্ণমূর্তি আমার সর্বতই প্রিয় – সত্যিই সে মেলডি কুইন। জাভেদ আলীর  গায়েকী ও আমার ভীষণ ভালো লাগে এবং বলাই বাহুল্য যে সে বলিউডের এখন প্রথম সারির একজন গায়কজীৎ গাঙ্গুলীকে আমি এই প্রথম দেখলাম ও জানলাম। তাঁর এত গান (হিন্দি ও বাংলা) যে সুপার হিট ও শ্রুতি মধুর আমার অজানা ছিল। আসলে গান গুলো খুবই শোনা কিন্তু তার সুরকার যে উনি এটা জানা ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা কালার্স বাংলার মঞ্চে আমরা তাঁকে পেলাম এক সেরা, অমায়িক, দরদী মানুষ হিসেবে তিনি  প্রকৃতপক্ষেই এক ঊঁচু দরের শিল্পী ও সত্যিই বাংলার গর্ব।

এবার আসি প্রতিযোগীদের কাছে। এক কথায় প্রত্যেকে অসাধারণ এক-এক জন খেলোয়াড়। কিন্তু এরই মধ্যে কিছু অসামান্য রতন  আছে যাদের এই মঞ্চ আমাদের কাছে উপহারেরে ন্যায় তুলে ধরেছে

() প্রথমেই বলব শ্রেয়ানের কথা হরিহরণ  ওঁর সম্বন্ধে বলেন, “হী ইজ গডস ওন চাইল্ডউক্তিটা একেবারে খাঁটি। শ্রেয়ান দেব শিশুর মতনই  সুন্দর, সরল, নিষ্পাপ, নির্বিকার চিত্তের মানুষ। এবং তার ও চেয়ে  বড় কথা সে অসম্ভব গুণী । বয়স কতই বা হবে কিন্তু বড়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অম্লানবদনে  কঠীন থেকে কঠীনতর গান গাইবার ক্ষমতা সে রাখে। তাঁর গানে এমন একটি ব্যাপার আছে যা বিচারকেরাও  ভাষায় প্রকাশ করতে অপারগ। কোন জায়গায় কতখানি নিক্তির ওজনে মেপে সুর লাগাতে হবে বা স্বর ক্ষেপণ করতে হবে যা ভালো ভালো গাইয়েরা বছরের পর বছর রেওয়াজ করে শেখে তা ছোটো  শ্রেয়াণের কাছে অনায়াসলব্ধ, সহজ ও মনে হয় অতি সাধারণ কথা। এমন দেবতুল্য শিশুর পিতা-মাতা কে বিচারকদের একটাই অনুরোধ,” এঁকে সযত্নে লালন-পালন করবেন এবং আরো ভালো করে গানের তালিম দেওয়াবেন

()  সায়নি দৃষ্টিহীনা কিন্তু এই অভাবটি ঈশ্বর তাঁর কন্ঠে পূর্ণ করে দিয়েছেন। সায়নির গলায় মা সরস্বতি বিদ্যমান। মনে পড়ে যায় কবির কথা – “পাখীরে দিয়েছ স্বর সে গায় গান, তার চেয়ে বেশী করে না সে দান, আমারে দিয়েছ স্বর আমি তারো চেয়ে বেশী করি দান, আমি গাই গান”। সায়নির গলার সুক্ষ কাজগুলি তাঁর গায়েকী কে এক নতুন পর্যায় পৌঁছিয়ে দেয়। তার সুরের আর্তি হৃদয় ছুঁয়ে যায় এবং এক আত্মিক অনুভূতির পরিচয় করায়।

(৩) তমোজীৎ এক কথায় ভার্সাটাইল। একের পর এক সে নানা ধরণের এবং ভিন্ন স্বাদের গান পরিবেশন করেছে। সব গানই সে বিশেষ পটুতার সঙ্গে গেয়েছে। সব চেয়ে বড় কথা আনন্দ হোক বা বেদনা বা হাসি-কৌতুকে ভরা – যেই গানের যা মুড সেই মুডে অক্লেষে ঢুকে পড়ার আর্ট তমোজীৎএর হাতের মুঠোয়। কিশোর হোক বা অরিজীৎ বা শঙ্কর মহাদেবন তমোজীৎ প্রতিটি গায়কের গান নিজের স্টাইলে প্রস্তুত করতে পারদর্শী।

(৪) অরূপ আমাদের কার্ত্তিক ঠাকুর। বাবার ইচ্ছা ছেলে নায়ক হোক। ছেলের ইচ্ছা গায়ক হব। বডি বিল্ডিং এর সাথে চলে গান চর্চা। মাজা গলা, গায়েকী সাবলীল ও বিশিষ্ট। রেওয়াজী ও মনোযোগী – দুয়ের নিখাদ সমাবেশ অরুপ। গত সপ্তাহের আগের সপ্তাহে কমিক সংগ  “ইয়ক চতুর নার” অত্যন্ত নিপূণতার সঙ্গে গেয়ে বিচারকদের তাক লাগিয়ে দিয়েছে অরুপ। হরিহরণের ভবিষ্যৎ বাণী, “অরুপ নেক্সট জেনারেশনের সিঙ্গিং স্টার”।

(৫) ত্রিপুরার বিশ্বজীৎ - কেউ গায় নাভি স্বরে, কেউ গায় কন্ঠ স্বর দিয়ে আর আমাদের বিশ্বজীৎ গায় হৃদয় দিয়ে। কোনো গানের ফর্ম্যাল ট্রেনিং না থাকা সত্ত্বেও বিচারকদের তাক লাগিয়ে বিশ্বজীৎ  সুর লাগায় ত্রুটিহীন ভাবে। প্রোগ্রামের মাঝে একবার আউট হয়ে গিয়েও জন সাধারণের উপচে পড়া অনুরোধে তাকে  আবার ফেরৎ আনাতে হল গ্রেট মিউজিক গুরুকুলের মঞ্চে ওয়াইল্ড কার্ড এন্ট্রীর মাধ্যমে। জাভেদ আলী বলেন সুফিয়ানা গানে বিশ্বজীৎএর কেউ হাত ধরতে পারবে না, অর্থাৎ বিশ্বজীৎ এর সঙ্গে  কেউ মোকাবিলা করতে পারবে না।

(৬) গত সপ্তাহে এক গোছ ওয়াইল্ড কার্ড এন্ট্রীর জন্য (আগেই বলেছি) আবার এক পশলা প্রতিদ্বন্দ হয়ে গেল যার মধ্যে দুজন সেরা কে বিচারকেরা বাছাই করে নিলেন। ঠীক বলেছেন এই সেই প্রতিদ্বন্দ্ব যা আমাদের বিশ্বজীৎ  কে আবার ফিরিয়ে দিল। বাকী দুজনের (আরেকজন গুরপ্রীত) মধ্যে শৈলীর গান মুগ্ধ করল বিচারক ও শ্রোতা  দুই কে। গানের মধ্যে যে শান্তির নিবাস তা শৈলীর গানে পাওয়া যায় - যাকে হিন্দীতে বলে ‘ঠহরাও’ আর বাংলায় স্থৈর্য । আশা করি শান্ত শিষ্ট শৈলী অনেক দূর অবধি যাবে।

গ্রেট মিউজিক গুরুকুলের বিশেষত্ত্ব আমি আগেই বলেছি – এর বিচারক মন্ডলী। এবং গানের অন্য প্রোগ্রামের ফর্ম্যাটের ধারা অবলম্বন করলেও (সিলেকশন/ পারফর্মেন্স/এলিমিনেশন/কম্পীটিশন/উইনিং) এই শো এর এক অনন্য ব্যাপার হল বিচারকেরা নেপথ্যে (অফ স্ক্রীন)  এবং মঞ্চে (অন স্ক্রীন)  গায়ক-গায়ীকাদের নানা ভাবে গুরু হিসেবেও গাইড্ বা দিগদর্শন করেন। আগে বলতে ভুলে গেছি প্রত্যেক বিচারক গুরুর ভূমিকাও পালন করছেন এবং তাঁদের চয়নিত শিষ্য মন্ডলী (অর্থাৎ গায়ক-গায়ীকার দল গুরু-শিষ্য পরম্পরা অনুযায়ী এক এক জন বিচারক অর্থাৎ গুরুর শিষ্য হিসেবে ও মনোনীত)  ছাড়াও অন্য গুরুর শিষ্যদের ও গায়েকীর ভুল-ভ্রান্তি ঠীক করে দেন। এখানেই গান-ভক্তদের (শ্রোতা ও পারফর্মার দুই হিসেবে) অনেক কিছু শেখার আছে যেমন স্বর নিক্ষেপ, মাইকে ভয়েস  থ্রো, ডিকশন, নোটেশন, গানের মুড বা সোল বজায় রেখে গান, গলার হরকতের সঠীক প্রয়োগ, প্রয়োজনীয়তা ও অপ্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি সব বিষয়ে নানা জানা-অজানা তথ্য গুরুজন বিচারকের মুখ থেকে পাওয়া এক বিশাল বড় প্রাপ্তি।  এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে নাম নেব হরিহরণজীর যিনি - বৈজ্ঞানিক ও এস্থেটিক - দুই মেরুর সংযোগে বোঝান ভালো গান গাওয়ার টেকনিক। তাছাড়া আমরা আরো পাই যখন  শ্রদ্ধেয় বিচারকেরা তাঁদের  হিট গান লেখা, কম্পোজিশান, রেকর্ডিং , ইত্যাদির অভিজ্ঞ্যতার স্মৃতিচারণ করেন। সেই গল্পের ছলে বলা কথার মধ্যে অনেক কিছুই আছে শিক্ষণীয়। তাছাড়া এদের গলার গান তো আছেই।

আবার এক-একটি এপিসোডে আমরা পাই নিত্য নতুন গানের জগতের তারক-তারকাদেরও গেস্ট হিসেবে । যেমন একটি এপিসোডে এলেন টলিউডের উঠতি গায়ক অনুপম রায়। আরেক এপিসোডে আমরা পেলাম কলকাতার সবার দিদি – ঊষা উত্থুপকে।

এখন শোটি যে পর্যায় পৌঁছিয়েছে তাতে এলিমেনশনের পর এগারো জন (ওয়াইল্ড কার্ড এন্ট্রী নিয়ে) প্রনিদ্বন্দ্বী এবং তাঁদের মধ্যে টাফ কম্পিটিশন এগারো থেকে এক হওয়ার। যারা এখনো পর্যন্ত এই প্রোগ্রামটাকে অগ্রাহ্য করেছেন তাঁরা ঝটপট শো এর শেষের দিকের মজা লুটতে পারেন। অবশ্য কিছু দিনের মধ্যেই ইউ টিউবে এর শুরু থেকে শেষ সব এপিসোডই আশা করছি দেখতে পাওয়া যাবে।

কালার্সের এই  প্রোগ্রাম মারফৎ প্রতিবেদন গানের জগতে কিছু তরাশ করা হীরে তুলে দেওয়া যারা পাবে নামচিন গায়ক-গায়ীকাদের সঙ্গে এ্যালবাম রেকর্ডিঙের সু্যোগ এবং আরো অনেক আকর্ষণীয়  পুরষ্কার। এটি প্রথম সীসন এবং আগত প্রতি বছর এমন এক-একটি উৎকৄষ্ট সীসন পেশ করার গুরুদায়ীত্ত্ব কালার্স নিজের হাতে তুলে নিয়েছে।

দেখতে ভুলবেন না যেন...