Tuesday, October 15, 2013

আমার কোনো তাড়া নেই


'' বাবু আমার পড়শী।  ছাপোষা মানুষ। হাঁসি হাঁসি মুখ;  ভীরু-ভীরু  চাউনি ; নরম গলার আওয়াজ।  নিরীহ গোছের ভালো লোক।   আজকের ছোটাছুটির জীবনে উনি এক রকমের ব্যতিক্রম বটে। ব্যতিক্রমের কথায় পরে আসছি। আগে বলি এই নিরীহ ও ভদ্র হওয়ার অপাংঙ্কত্তেও যোগসাযোগের বিষয়ে। আজগের যুগে যে ভদ্র সে নিরীহ তো বটেই। আবার যে নিরীহ সে অনায়াসেই ভদ্র লোকের পর্যায় পড়েই যায়। কারণ ভদ্র মানেই ভীত, সন্ত্রস্ত, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না, মুখ তুলে তাকাতে সাহস করে না, নির্ভীক চিত্তে প্রতিবাদ করতে ও  পারে না বা  রুখে দাঁড়াতে ও অক্ষম। এ জাতীয় মানুষ কে আমরা সাধারণতঃ ভদ্র লোক ব’লে জানি। উনি খুব ভদ্র কোনো ব্যাপারে সাতেও নেই আর পাঁচেও নেই। এটা আমাদের সামাজিক বললে ভুল হবে, বরং  বলব ‘সভ্য’ হবার মাপদন্ডের একটি অলিখিত আইন। যে সভ্য তাঁর মাথা নত। যে যত বেশী অসভ্য তাঁর গলার বৈকি গায়ের জোর ও  ততধিক।
 
 আপনারা হয়তো জানতে চাইবেন ভদ্র লোকের এই বিষদ ব্যাখ্যাটি কোন গ্রন্থে আখ্যায়িত। জবাব হ’ল কোনো গ্রন্থেই নয়। তবে এই ব্যাকরণটাই ভদ্র হওয়ার বাস্তবিক রূপ।   অবাক কান্ড! আমি বলব এটা একটা এনোম্যালি নিশ্চয়। যে সৎ তার গলার জোর প্রবল হওয়া উচিত। যে সাহসী সে ভদ্র কী হতে পারে না? যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না সে তাঁর উত্তরসুরি কে কী দিয়ে যাবে বলুন তো? শুধু মাত্র ভদ্র হওয়ার একটা বাইরের মুখোশ আর মনের মধ্যে অনেক খানি আকুলি বিকুলি নিয়ে বেঁচে থাকা ? কারণ ভদ্র হ’য়ে বাঁচা মানে নিজের অধিকার দাপটের জোরে ছিনিয়ে নিতে সে অপারগ ? সমাজিক দায়বদ্ধতা কী শুধুই ভদ্রলোকেদের জিম্মায়?     
 
বিষয়টা গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। কথার মোড় ঘোরাই। আসি আমাদের ‘অ’ বাবুর প্রসঙ্গে।  আর প্রথমে যা বলেছি তা আবার বলি। ‘অ’ বাবু শান্তি প্রিয় মানুষ। মুখে রা নেই। তবে কেন তাকে নিয়ে আলোচনা? শান্ত, অবিচল, নিয়মবদ্ধ জীবন সম্বন্ধে বলার বিশেষ কিছুই থাকে না কারন সেই জীবনে কোনো চাঞ্চল্য, কোনো এক্সাইট্মেন্ট,  কোনো ওঠা-পড়া নেই। একই প্রবাহে জীবন কেটে যায় নিশ্চিত গতিতে। এই নিশ্চিত ধারাবাহিকতায় রোমাঞ্চ কোথায়? কোথায় গল্প? কোথায় না-পাওয়ার ব্যথা? কোথায় অযথা ক্লেষ? শান্ত-শিষ্ট ল্যজ বিশিষ্টরা সব কিছু অক্লেষে মেনে নেয়। এই মেনে নেওয়াতেই সোয়াস্তি। আবার এই অক্লান্ত মানিয়ে নেওয়ার মধ্যেই বোধহয় আরেক ধরণের বেঁচে থাকার স্বাদ, মোহাচ্ছন্নরা যেই স্বাদ থেকে বঞ্চিত।
 
আগেই বলেছি ‘অ’ বাবু একটি ব্যতিকম। ব্যতিক্রমটি কী এবার বলি। না, তিনি স্বভাবসুলভ মিতভাষী, স্মিতহাস্য কিম্বা অমায়িক – এগুলো তাঁর গুণ হতে পারে কিন্তু ব্যতিক্রম নয়। ব্যতিক্রম তাঁর একটিই। সেটা হল এই ছোটাছুটির জীবনেও তিনি যেন তূষারপিন্ডের মতন শীতল। যাই বলি না কেন তাঁর মুখে চঞ্চলতার কোনো রেষ আঁকে না। শুধু আমি কেন কারও কথাতেই সেই নিষ্পৃহতায় ব্যাঘাত ঘটে না।  নিষ্পৃহ বললে ভুল হবে। এক প্রগাঢ় প্রশান্তিতে তাঁর মিখমন্ডল সব সময় ভাসিত। সেদিন কী একটা চাইতে এসে লাজুক ভাবে মুখ নীচু করে ব’ললেন, “দিদি যখন সময় হবে দিয়ে দেবেন। আমার কোনো তাড়া নেই”। এই “আমার কোনো তাড়া নেই” সাধারণ চারটি শব্দ ওনার মুখে লেগেই আছে। যে যাই বলুক না কেন।   আর এই চারটি শব্দই  আমায় বিশেষ করে নাড়া দিয়ে যায় যখন দেখি সময়াভাবে মানুষ মানুষের সঙ্গে সাধারণ  আলাপচারিতার ও সুযোগ করে উঠতে পারে না।  এই অহরহ ছোটার তাগিদে আমিও শামিল। ‘অ’ বাবুকে হিংসে হয়। মাঝে-মাঝে মনে হয় সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবন-যাপনরত, অজস্র অভাব-অনটন সত্যেও ‘অ’ বাবু কত সুখি, কত ধনি। আবার ভাবি উনি কী জীবনের সঙ্গে চরম বোঝাপড়া করে ফেলেছেন না জীবনটাকে সত্যি পরিপূর্ণ রূপে জিইয়ে নেবার চাবিকাঠি খুঁজে পেয়েছেন?
 
 
ভাবি কিন্তু এখনো উত্তর পাইনি। কারণ এহেন মানষিকতা আমায় যতই প্রভাবিত করুক না কেন আমি এ ধরণের নির্বিকারতা থেকে এখনো বঞ্চিত। হয়তো কোনো দিনই আমি ‘অ’ বাবুর মতন বাচঁতে বা ভাবতে পারব না।
 
তবু ও...। আপনাদের কী মনে হয়?
 
 


 

 

Wednesday, July 31, 2013

জোয়ার ভাটা




অভ্র  সফ্ট ওয়ারটা  কাজ না করার দরুণ  আবার  বাংলা লেখায় ভাটা পড়ল।  মনটা  অনেকদিন হলো ছটফট   করছিল কিছু লিখব-লিখব করে।  কিন্তু  লেখার উপায় নেই তাই মনমরা হয়ে পড়ে  থাকা ছাড়া আর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না - তবে আর না।  ঠীক করলাম আজ অন্তত দু লাইন লিখেই  ঘুমোবো।  সেই কারণেই ব্লগে আসা।   
 
আর এসেই বাংলা ফণ্টটা  সিলেক্ট করে টক-টক করে কীবোর্ডে টোকা মারতেই প্রিয় স্ক্রিপ্টটা  পি-সি-র  পর্দায় ভেসে  উঠল।  মনটা আবার টগবগিয়ে উঠেছে।  কিন্তু এখন আর না, রাত অনেক হলো।  এবার শুতে যাবার তাড়া।  বাকি কাল..... শুভ রাত্রি। 

 

Wednesday, July 10, 2013

Flight


 
The bars were icy cold and invincibly strong through which could be glimpsed a grey, gloomy corridor lined by narrow prison cells winding away to infinity.

The cells were occupied by men shunned by sane society, imprisoned for life, and he was one of them, though he, even after two and a half decades, did not know why he was there in the first place.

But tomorrow would be another day when he would be set free, on parole, on account of good behaviour.

Tomorrow he would walk out of this sinister dungeon with his head held high, a smile on his face and a secret pulsating in his heart.  

Tomorrow he would head straight to his cottage amidst the lonely hills where he knew she was waiting for him, with thudding heart and thirsty lips, whom he had murdered with his own hands, two and a half decades back and courted arrest!
 

Sunday, May 05, 2013

ভৌতিক (তারপর)

নতুন পাঠক-পাঠিকারা এই গল্পের  প্রথমাংশ পড়ুন এখানে

(১)
 
 
 
বাড়ীটার কোনো শ্রী ছাঁদ নেই। বাইরে থেকে অনেকটা পোড়ো বাড়ীর মতন দেখতে লাগে। কিছু কিছু জায়গায় দেয়াল থেকে চুন বালি খসে পড়ে ইঁটের সারি দেখা দিয়েছে। চুনকাম প্রায় কয়েক বছর ধরে করানো হয়নি। বাড়ীওয়ালা কেবল মাসের শেষে ভাড়ার টাকা গুনতে ইচ্ছুক। আমার পিসেমশাই একটু কৃপণ প্রকৃতির মানুষ। নিজের গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে বাড়ী সারানোর বা চুনকাম করানোর লোক নন্। তবে ওঁকেও ব্লেম দেওয়া যায় না। ভাড়া বাড়ীর উপর কেই বা নিজের মাথার-ঘাম- পায়ে-ঠেলা আমদানি থেকে খরচা করে মশাই?

বড় রাস্তার উপরে পিসেমশাইদের পৈত্রিক ভিটে। বিশাল চার-তলা বাড়ী। এখন মামলাধীন। ভুল করে পুলিশকে ভাড়া দিয়ে সর্বনাশ ডেকে এনেছেন পিসেমশাইয়ের বড় দাদা। এখন ঠেলা সামলাও। পিসী মাঝে-মাঝে রেগে বলেন, “ও বাড়ী জন্মেও ফেরত পাবে না। আরো দাও পুলিশকে ভাড়া”। 

এ বাড়ীর ভিতরটা আরো সরেষ। সদর দরজা পেরিয়ে বেশ কিছু খানি জায়গা খালি পড়ে আছে। আগাছার বন । কেউ পরিষ্কার করায় না। বাঁ দিকে বাড়ীর ভেতরে প্রবেশ করার দরজা। এক ফালি চওড়া উঠোনের পর কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে আবার আরেক খানা চওড়া দালান। দালান দিয়ে ঘরে ঢোকার পথ। বড় বড় দুটো ঘর পাশাপাশি। কিন্তু এক ঘরের সঙ্গে দ্বিতীয় ঘরের কোনো যোগাযোগে নেই। বিরাট বিরাট খড়খড়ি দেওয়া জানালা। আসবাবপত্র গুলিও সেকেলে। সব চেয়ে বড় কথা বাড়ীর ভেতরে গোসল ঘর নেই। সেটা উঠোন পেরিয়ে বাড়ীর প্রবেশ পথের কাছে। রাত্রি বেলা অন্ধকারাচ্ছন্ন উঠোন পেরিয়ে গোসলখানায় যেতে গা ছমছম করে। তবে বাড়ীটির বিশেষত্ত্ব হচ্ছে বিশাল রান্না ঘরখানা। সেটাও বাড়ীর ভিতর ঢুকতেই ডান দিকে পড়ে। 

তবে এসবই টের পেয়েছিলাম, মানে ভালো ভাবে দেখতে পেয়েছিলাম , এখানে আসার এক মাস পর। এক মাস বিছানায় সিঁটিয়ে পড়ে থাকলাম। কথা বলার জো নেই। দুর! ঢোকই গিলতে পারি না তো আর কথা কেমন করে বলব? 

পিসী-পিসের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। বড় পিসীর বিয়ে হয় দেরীতে। ছোটো পিসীর বিয়ে আগেই হয়ে গিয়েছিল। বিয়েতে দেরী হচ্ছে দেখে আমার বাবা বড় পিসীকে সরকারি চাকুরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন এবং সেটা যে আখেরে পিসীর জীবন পালটে দিয়েছিল সেই গল্প আবার আরেক দিন করব। 

আমি ১৯৬০ সালের কথা বলছি। সেই যুগে মহিলারা বড় একটা চাকুরি করতেন না। পিসীর সেকালে চাকুরি করাটা প্রায় একটা বৈপ্লবিক ব্যাপার এবং আমার বাবার উদার মনোভাবের প্রতীক। পিসীর বিয়ের আগের জীবন কেটেছে একান্নবর্তী পরিবারে। মা হেসেঁল ঠেলতে ব্যস্ত থাকতেন। আর আমি পিসীর কাছে রামায়ণ-মহাভারতের গল্প শুনে বড় হচ্ছি । পিসীর ফুলশয্যের দিন আমি নাকি বায়না ধরেছিলাম যে পিসীর সঙ্গে আমিও ওঁর শ্বশুড় বাড়ী যাব। তখন আমি খুবই ছোটো। তারপর বাবার চাকুরি বদল ও আমাদের দিল্লী পারি দেওয়া। আর লম্বা সতেরো বছর পর আমার আবার কলকাতা ফিরে আসা। সেসব অনেক কথা। 

মোট কথা আমি এক কালে পিসীর ন্যাওটা ছিলাম। পিসী ও আমাকে যাইপরোনাস্তি  নিজের সন্তানের মতনই ভালোবাসতেন। মনে হয় পিসেমশাইও আমাকে স্নেহের চোখে দেখতেন। তবে তিনি ছিলেন রাশভারী গোছের মানুষ। মুখে ও বাক্যে ভাবাবেগের প্রকাশ ছিল কম। মাম্পসে ভোগাকালীন খেতে ভালো লাগত না। পিসীর কথা শুনতাম না তাই পিসী পিসেমশাইয়ের হাথে এক থালা ভাত আর পঞ্চ ব্যঞ্জন পাঠিয়ে দিতেন। কোন খাবারে কী-কী ভিটামিন ও মিনারেল আছে যা আমার রোগাক্রান্ত শরীরের জন্য প্রয়োজন ধৈর্য্য ধরে ফিরিস্তি দিতে-দিতে পিসে আমায় প্রায় জোর করে পুরো খাবারটা খাওয়াতেন। আমার কোনো ওজর আপত্তি কিছুই তখন তিনি শুনতেন না । আমি ওঁকে একটু ভয় ও পেতাম তাই খুব একটা জোর প্রতিবাদ ও করতে পারতাম না। কী ভীষণ শাস্তি রে বাবা!
 
(২)


 
 







জীবনের চালচিত্রটা খুঁটিয়ে দেখলে নানা রকম আঁকিঝুঁকি হিসেব-বেহিসেব , টেড়া-মেড়া, অবশ্যম্ভাবী গোলকধাঁধাঁ পাওয়া যায়। বেশী মাথা ঘামালে মাথা ঝিমঝিম করে হাথ পা অবশ হয়ে আসে, কিছুই আর বোধগম্য হয় না ; শেষ-মেষ সব হিসেবেই গরমিল দেখা দেয় আবার সেই গরমিলই যেমন গন্ডগোল বাঁধায় তেমন অনেক সমস্যার সমাধানও আপনেসে সামনে হাজির করে আনে। বৈচিত্র্যবিহীন জীবন চলে না। আবার বৈচিত্র্যর মানে খুঁজতে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়। মোদ্দা কথা জীবনটাকে as it is মেনে নেওয়া। সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটা বোকামি। সেই বোকামি প্রায় সই সবাই করে থাকে। আমিও করতাম, এখনো করি। কথায় আছে স্বভাব যায় না ম’লে।

পিসীর বৈবাহিক জীবন সুখকর হয়নি। সেটা সন্তানাভাবে না মনের অমিলে আমি সঠিক বলতে পারব না। তবে যেই সময়ে আমি মাম্পসাক্রান্ত হয়ে পিসী-পিসের শরণাপন্ন হই সেই সময়টা তাঁদের দাম্পত্য জীবনের সব চেয়ে জটিল পর্যায়। প্রায় সই ঝগড়া বাঁধত দুজনের – একে অন্যকে দোষারোপ ও বিদ্রুপ করা, খোঁটা দেওয়া; একে অন্যের প্রতি মান-অভিমান, ক্ষোভ, দুঃখ, রেষারেষি ভাব, রাগ - সব জট বেঁধে একটা সংক্রামক ব্যাধির আকার ধারণ করে ফেলেছিল। খারাপ লাগত। দুজন প্রিয় মানুষের মন কষাকষি দেখে। আমার পরবর্তী জীবনের একটি বিশেষ নির্ণয় এই অপ্রাপ্তবয়সে দেখা দাস্পত্য ক্লেষের দ্বারা ভীষণ ভাবে প্রভাবিত। কিন্তু এই অমিলেই যে মিল ছিল সেটা তখন বুঝতে পাইনি। আগেকার দিনের মানুষদের বোঝা তুলনামুলকভাবে কঠিন কারণ তাঁরা অনেক কিছু প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক ও অনেক কথা স্বভাবতই গোপন রাখতেন। আজকালকার দম্পতিরা সেই অনুপাতে অনেক মন ও মুখ খোলা – যাকে বলে ওপেন বুক। তাঁরা তাঁদের নিজস্ব জীবনে ও সম্পর্কে নানা প্রকার কলহ, বাদ-বিবাদ, বিভেদ অক্লেষে প্রচার করতে পেছ পা হন না। সব কিছুর পিছনেই একটা মাইলেজ আদায় করার ট্রেন্ড দাঁড়িয়ে গেছে। এটা বধহয় বিক্রয়বাদ সমাজের বিবর্তনের জ্বলজ্ব্যান্ত দৄষ্টান্ত মাত্র। আঃ ! আবার অন্য বিষয়ে চলে গেলাম। ফিরে আসি...

 

(৩)

 
 
মাস খানেক ছুটি নিয়ে পিসী দিন রাত আমার সেবা শুশ্রূষা করলেন। এক মাসের মাথায় পিসী একদিন একটু অপ্রস্তুতভাবেই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুই কয়েক ঘন্টা একা থাকতে পারবি ? লম্বা ছুটি নিয়ে ফেলেছি। কাল অফিস না গেলেই নয়। তবে যাব আর আসব। ব্যস! তারপর আবার কিছু দিন ছুটি করব”। আমি মাথা নেড়ে বলি, হ্যাঁ থাকতে পারব...

পিসী আশ্বাস দিয়ে জানান যে তাঁর অবর্তমানে পীসেমশাই বাড়ীতেই থাকবেন। অফিস যাবেন না । তবে ওঁর থাকা না থাকা একই ব্যাপার কারণ পিসী না থাকলে উনি সচরাচর এ ঘরে আসেন না । 

পরের দিন সকালে রান্না-বান্না করে আমাকে খাইয়ে পিসী অফিসে চলে গেলেন। আমিও খবর কাগজ ও পিসীর দেওয়া বই পত্র গুলো নাড়াচাড়া করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম সেটা টেরও পেলাম না। ওফ!!! আবার সেই বুজ্ রুকি দেওয়া গপ্পো। টের পেলে ঘুমোব কী আর ঘুমোলে টেরটাই বা পাব কেমন করে?



(৪)



 
মাঝ দুপুরে ঘুম ভেঙ্গে গেল। এখন কটা হবে ? ঘড়ির দিকে নজর যেতে একটু অবাকই হলাম। মাত্র সাড়ে তিনটে। খড়খড়ি দেওয়া জানালা দিয়ে গরম বাতাস ঘরের ভেতর ঢুকছে। পাল্লাটা হাওয়ায় খুলে গেছে। তাই বোধহয় ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। উঠে যে জানালাটা বন্ধ করব তা আর ইচ্ছে করল না । শুয়ে-শুয়ে ভাবছি কী করি। ঘুমটা সেই যে চটে গেল আর আসছে না । এপাশ-ওপাশ কিছু ক্ষণ করে আবার কখন চোখটা লেগে গেল বুঝতে পারিনি। 

বড় রাস্তার উপর বাড়ী। বাইরে নানান গাড়ী-ঘোড়ার শব্দ লেগেই আছে। কিন্তু আজ বড় একটা আওয়াজ পাচ্ছি না। সেই বিরক্তিকর পীচ  ঢালা রাস্তার  উপর চাকার ঘড়ঘড়ানি আর হর্নের হনহনানি;  রকবাজ ছেলেদের আড্ডায় হাঁসির রোল আর ফেরিওয়ালাদের ডাক। কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেছে সব কিছু। এমনটা রোজ হয় না। সব সময়ই এই জানালাটার বাইরে রাস্তা জমজমাট। 

নিরবতা যে অস্বস্তিকর হতে পারে তাও আবার ভর দুপুরে সেটা এই প্রথম অনুভব করলাম। কিছু করার নেই। জ্বর নেই তবুও কেমন যানি একটা ক্লান্তির আবেশ মজ্জায়-মজ্জায় ছড়িয়ে আছে। পাশ ফিরব ভাবলাম কিন্তু পাটা মনে হ’ল পাথরের মতন ভারি হয়ে গেছে । নড়তে-চড়তে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এখন তো আমি প্রায়ঃ সুস্থ! বাইরের দালানে খুট করে একটা শব্দ হতে দরজার দিকে নজর যেতেই বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। ভেজানো দরজাটা কে যেন একটু-একটু করে বাইরে থেকে খুলছে। আরেকটু...আরেকটু...

ভাবলাম চেঁচিয় জিজ্ঞেস করি, “ কে? কে ওখানে ?” কিন্তু গলাটা কেমন যেন বুজে আসছে মনে হ’ল। তারপর খুট করে আরেক টা আলতো শব্দ করে দরজাটা খুলেই গেল। চৌখাটে পিসেমশাই দাঁড়ান, “ কী মিঠু এখনো ঘুমোওনি বুঝি? কিছু চাই?” গলার স্বারটা কেমন ধরা-ধরা , নাকি-নাকি। মাথা নেড়ে জানাই, না কিছু চাই না। তবুও পিসেমশাই ভেতরে দুপা এগিয়ে এলেন। একটু যেন অবিন্যস্ত অবস্থা। প্রায়ঃ চলতে-চলতে টাল খেয়ে পড়ে যাওয়ার মতন। খাটের কাছে এসে কী ভেবে ফিরে আলমারি থেকে কী একটা জিনিস বার করে আবার ধরা গলায়, “ঘুমিয়ে পড়” বলে টলতে-টলতে বেরিয়ে গেলেন। দরজাটা ও বন্ধ হয়ে গেল। খুট করে আবার সেই শব্দ। ছিটকিনি দেওয়ার? খাটের পাশেই দক্ষিণা-কালীর বিশাল একটা ফোটো সোনালি কাজ করা ফ্রেমে বাঁধানো। অনায়াসে  সেই ছবিটার দিকে চোখ পড়তে মনে হ’ল মায়ের চোখ দুটো যেন রোজের চেয়ে বেশী জ্বল-জ্বল করছে। হিংস্র...ক্ষুধার্ত... কিন্তু দক্ষিণা কালী যে মায়ের মাতৄরূপ ?

 বলাই বাহুল্য এর পর পিসীর আশা অবধি আমি সময়টা জেগেই কাটাই। বার-বার দরজার দিকে চোখ গেছে আর কান খাঁড়া ছিল খুট করে ছিটকিনি খোলার শব্দ শোনার জন্য। দুটোর মধ্যে অবশ্য একটা ও আর হয়নি।


(৫)
 

 

এর পরের ঘটনা খুবই সামান্য। এক সপ্তাহের মাথায় সুস্থ হয়েই বায়না ধরলাম “আমি মার কাছে যাব”। পিসেমশাই রাজধানির টিকিট কেটে আমায় বাড়ি পৌঁউছে দিয়ে গেলেন। আসার আগে পিসী একদিন একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন,” হ্যাঁরে ! যেদিন আমি অফিসে গিয়েছিলাম, তুই একলা ঘরে ভয় পাসনি তো”? আমি পাল্টা প্রশ্ন করি, “ পিসী, তুমি কোনোদিন ওই ঘরটাতে কোনো অশরীরি কিছু অনুভব করেছ ?” “কেন বল তো?” পিসির কৌতুহল বাড়ন্ত । “না, মানে যেমন গা অবশ করা , মাথা ঝিম-ঝিম করা, জানালার খড়খড়ি আপনা-সে খুলে গরম লূ ঘরের মধ্যে ঢোকা...আর মা-কালীর সেই জ্বল-জ্বল করা চোখ দুটো”? পিসী কিছুক্ষণ আমার দিকে অন্যমনস্ক ভাবে তাকিয়ে থেকে আলতো মাথা নেড়ে জবাব দেন, “ হ্যাঁ করেছি”।
 

 
 

 
 বাড়ীটারইতিহাস পিসেমশাইয়ের বাল্য বন্ধু পরিতোষ কাকুর মুখে শোনা। এ বাড়ীটা কোনো এক অখ্যাত, বা বলতে পারেন কুখ্যাত, জমিদারের বাগান বাড়ি ছিল। এক অমাবশ্যার রাতে কোন এক বাঈজীকে গুম-খুন করে এই বাড়ীর পিছনের কুঁয়োতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। আবার কেউ-কেউ বলে বাড়ীটার ন্যাঁড়া ছাদ থেকে কোন এক অপরিচিত মহিলা নাকি এক নিশুতি রাতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। গল্পের গরু অনেক রকম ভাবে গাছে চড়ে।
 
শেষ কথা হল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শরীকেরা মিলে বাড়ীটি দু-ভাগ করে এক মালদার ব্যাবসাদারকে বিক্রি করে দেয়। কুঁয়োটা সৌভাগ্য-বশতঃ বাড়ীর অপর ভাগে পড়ে। কিন্তু গোপ্পেদের রটনা – কোনো-কোনো বিশেষ রাতে এ বাড়ীতে এক সাদা কাপড় পরা সুন্দর মহিলাকে ছাতে আনা-গোনা করতে দেখা যায়। পিসী নাকি তার পায়ের আওয়াজ ও মাঝে-মাঝে শুনতে পায়। পিসেমশাই মুখ বেঁকিয়ে বলেন, “তোর পিসির ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা। জ্যান্ত মানুষের খোঁজ রাখে না । শুধু মৄত মানুষদের নিয়ে কারবার”। আমার মন্তব্যটা ভাল লাগে না তাই চুপ করে থাকি।

 
 
(৬)




 
দিল্লী ফিরে দেখি দিদি একবারে সুস্থ। তবে মার মুখ ভার। এক ঝাঁক বকাবকির পর বললেন, “দিলি তো সব প্ল্যান ভেস্তে”?
 
আমি, “আবার কী প্ল্যান”?
 
মা, “কলকাতা যাবার আর কী। তোকে নিতে যেতাম আর সবার সঙ্গে দেখা ও হয়ে যেত। তোর বড় পিসীকে তো লিখেছিলাম আমরা আসব বলে। বলেনি তোকে”?

চুপ করে থাকি আর মনে-মনে ভাবি...

যাক সে সব কথা।

আমার গল্পটি ফুরোল নটে গাছটি মুড়োলো।