Saturday, October 06, 2012

দ্রাক্ষা ফল টক!


জীবনে বিফলতার আলাদাই দাম আছে। কেউ মানুক ছাই না মানুক, আমি মানি, আমি জানি, এবং এই গুহ্য অনুভূতির খবর সেই রাখে যে জীবনে নিষ্ফলতার স্বাদ ভোগ করেছে। কথাটা ক্লীশেড (clichéd) অর্থাৎ বহু সংখ্যক বার নানা ভাবে বহু প্রাজ্ঞ ব্যাক্তির মুখে শোনা, বহু বিধ মঞ্চ আলোড়িত করে চর্চিত, বহু আড্ডায় তুফান তুলে আলোচিত ও গর্বিত স্বরে ঘোষিত - তাই নয় কি?

তবু ‘আমি বিফল’ এই কথাটা কেউ মুখ ফুটে বলতে চায় না। বিফলতা লজ্জাদায়ক, প্রেরণাদায়ক নয়। কিন্তু আশ্চর্যের ঘটনা এই যে অনেক নামচিন ব্যক্তি নিষ্ফলতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই সফলতার মুখ দেখেছেন। মজার ব্যাপার এই  যে , সফল ব্যাক্তি গর্বের সঙ্গে বলতে পারেন ‘আজ আমি সফল কিন্তু এক কালে এই আমি বিফলতার দহনে দগ্ধ ছিলাম’কিন্তু যে হামেশাই অসফল, তার অসফলতা তার জীবনের মাপকাঠি  হ’য়ে দাঁড়ায়। ‘ও লোকটা জীবনে কিছু করতে পারলে না’, শ্লেষোক্তি; ‘উনি কি ছিলেন আর এখন কোথায় পৌঁছেছেন,’ সম্মানোপযোগী বইকি!

বিফল মানেই পুরুষার্থের অভাব; সফল মানেই অসাধারণ কর্মঠ । সব সময়ই কি তাই? ‘লাক ফেক্টার’ ইংরাজীতে একটা কথা আছে – ভাগ্য সদয় – সব   ব্যাঞ্জনে নুনের মতন অপরিহার্য। এ যুগের যুবক-যুবতী বর্গ একথা মানতে অনিচ্ছুক (তাঁরা ভাগ্যকে নিজের হাতে গড়ে নিতে চায়)। বেশ কথা। বয়স কালে আমি ও মানতাম না । এখন মানি? হয়ত মানি । মেলোড বাই এজ – অর্থাৎ বিগতযৌবনার অনুশোচনৌক্তি। হতে পারে। তবে অনেক সময় দেখেছি পরিশ্রম কাজে দেয়নি, যা চেয়েছি তা পাইনি – উদ্যমের অভাবে নয় নিজেকে ঠীক সেরকম ভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরতে পারিনি তাই। যাকে ইংরাজিতে বলে ‘হাইপ’, মেনেজমেন্টের বুলিতে বলে ‘এক্সপোজার’কর্পোরেট জগতে কর্মীর মেরিট, শ্রম ও অধ্যবসায়ই শেষ কথা নয়। চাকুরীক্ষেত্রে আমি একটি মার্কেটেবল কমোডিটি  আমার মার্কেট ভ্যালু আমার সেলেবিলিটির উপর নিরভর্শীল মোদ্দা কথা হ’ল আমি নিজেকে সেল করতে পারিনি। গোঁড়ায় গলদ। চাকুরী জীবনের শুরুতেই সুমনের সেই বিখ্যাত গানটা শুনে ফেলেছিলাম – ‘ যদি ভাব কিনছ আমায় ভুল ভেবেছ’। এবং তাদ্দ্বারা ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম ।

সে কথা বাদ দিলাম না হয় ।

তাহলে সফলতার পরিমাপ কী ? মাথার ঘাম পায়ে ঠেলে কাজ করে যাওয়া চুপিসারে ? নাঃ, সেটা আমার মতন চিনির বলদের একপেশে ট্রেডমার্ক । এই প্রোফেশনাল তাড়িত যুগে সফলতার চাবিকাঠি একটাই -  কিছুটা কাজ (দেখানো!), কিছুটা প্রোফিশিয়েন্সি আর অনেক খানি এগজিবিশনিজম্। মানে এক আনা কর্ম  নিপুণতা বা দক্ষতা আর ষোলো আনা আড়ম্বর। এই ফর্মুলা/মন্তব্য বিতর্কের ঝড় তুলবে। তুলুক।

আজকালকার ৮০% প্রোফেশনালদের আমি এইরুপ  মনোভাব পোষণ ও উক্তি জ্ঞ্যাপন করতে শুনেছি। সার মর্ম এই যে আমি এরকম প্রোফেশনাল নই, ছিলাম না, হতে পারব না, হওয়ার ইচ্ছা রাখিনা। আমি বিফলকামই সই।

‘কি পাইনি, তার হিসাব মেলাতে মন মোর নহে রাজি’। 

বিফলতা আমায় মজবুত করুক। সুখের চেয়ে শান্তি ভালো। শান্তির চেয়ে ও সোয়াস্তি আর সন্তুষ্টি ভালো। আর তার চেয়ে ও ভালো নিজেকে সব সময়  প্রুভ করার স্ট্রেস থেকে মুক্ত থাকাএটা যদি  ইনকম্পিটেন্ট ও যোগ্যতাহীনের দার্শনিকতা বলে মনে হ’য় – তবে তাই।

---

রাত একটা নাগাদ ব্লগটি লিখে কী খেয়ালে ফেস বুকে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে সবুজ, আমার সাথী-ব্লগারকে অন-লাইন পেলাম। দেড়টা অবধি চ্যাট করে শুতে গিয়ে মনে হল ব্লগটা সততই নিরপেক্ষ হয়নি। সত্যিই কী পরিস্থিতি বিফলতার জন্য দায়ী ? কোথাও কী ডিটার্মিনেশনের অভাব ঘটেনি? কখনো কী শ্রমে মাঝ পথে বিরাম টেনে হাল ছেড়ে দিইনি? তাড়াতাড়ি পরাজয় স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যেও কী পলায়নবাদী মনোভাব দৄষ্ট নয় ? সব প্রশ্নের উত্তর শৎ-প্রতিশৎ  হ্যাঁ না হলে ও আবার একশো ভাগ না ও নয়।

জীবনটা হ্যাঁ-নার পাঁচমিশালী ডাল। ফোঁড়নের অভাবে ফিকে হয়ে গেছে। এক-কালে ভালো রাঁধুনি বলে খ্যাতি ছিল। আজকাল মশলার প্রোপর্শন গুলিয়ে যায়। তাই ফলাহার করেই দিন ব্যয় হয়। রসদের অভাব তাই ভালোমন্দ খাওয়া জোটে না । আর সে জন্যই হয়তো দ্রাক্ষা ফল টক!!    

রান্নায় যেমন ফোঁড়ন আর মশলার মাপ-ঝোঁক খাদ্দ্যের স্বাদ কমায় বাড়ায়, তেমনি জীবনের স্বাদ ও (সফলতা- বিফলতার) আমাদের নিজস্ব ফোঁড়নের আর মাল-মশলার আঁকিঝুকির উপর নির্ভরশীল। কোথাও মশলার অভাব ঘটেছে কিম্বা কোথাও হয়েছে আধিক্য। যেমন পিছনে হটে যাওয়া দেয় পরাজয়ের গ্লানি তেমনি এগিয়ে না আসাও দিয়েছে আরো পিছনে ঠেলে। কোনটা ঠীক বলা মুশকিল – পিছনে হটে যাওয়া না এগিয়ে না আসা। ভেবে দেখতে হবে। সঠীক মুল্যায়ণ বিচার সাপেক্ষ। তবে এটা ঠীক হিসেব শেষ-মেষ হরেদরে সমান। তাই আবার বলি – “জীবন খাতার প্রতি পাতায় যত কর হিসাব- নিকাশ কিছুই রবে না ”।  

আসি...